সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও ইতিহাস

নিঝুম তালুকদার আদিবাসী প্রসঙ্গ বস্তুতঃ বাংলাদেশে ‘ইন্ডিজেনাস’ বা ‘আদিবাসী’ কারা তা একটি মীমাংসিত বিষয়। কিন্তু তারপরও সরকার ও বাঙালী জাত্যাভিমানী-সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন একটি গোষ্ঠী জেনেও না জানার ভান করে আদিবাসী নিয়ে বিতর্কের অবতাড়না করছে। বিষয়টিকে জটিল রূপ দিয়েছে। ‘আদিবাসী’ বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল বা বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে সরকার আদিবাসীদের ন্যায্য অধিকারকে অস্বীকার করতে চাইছে অথবা তার দায়দায়িত্ব থেকে সরে যেতে চাইছে। অন্য কোন দেশে এমন হয়নি। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ এবং গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তি বলে দাবীদার আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছে। আবার বলা যেতে পারে, সরকার বর্তমানে আদিবাসী বিষয়ে ও আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে বা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। অথবা আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে সরকার যে চরম রক্ষণশীল, এমনকী প্রতিক্রিয়াশীল- তার মুখোশই উন্মোচিত হয়েছে। এ জন্য এই সরকারকে একদিন মাশুল দিতে হবে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের আদিবাসীরা হুট করে নিজেরাই নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ বলে দাবী করে বসেনি। জাতিসংঘ

চাকমা রাজবংশের বিজক ও পিরি

নিঝুম তালুকদার

৫১তম চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের রাজপিরি ও বিজোগ
বিগত কয়েক দিন আগে আমার আলোচনা পোষ্টে "চাকমা রাজবংশের ইতিহাস"টি নিয়ে বিভিন্ন মহলের আরো চাকমা রাজবংশের ইতিহাস সর্ম্পকে জানার আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। তাতে আমারও উৎসাহ অগ্রসর হয়। আমিও উৎসাহ নিয়ে বিজোক ইতিহাস ঘাটাঘাটি করি। ইতিহাস সুত্রমতে বর্তমান চাকমা সার্কেলের রাজা দেবাশীষ রায়ের আমলে তিনি ৫১তম চাকমা রাজা যেভাবে হলেন তা নিয়ে আলোচনা শুরু করি।
০১. অতি পুর্বকালে হিমালয়ের পাদদেশে শাক্য নামে এক রাজা ছিলেন। কলাপ্যা নগর তার রাজ্যের রাজধানী ছিল। তিনি ঐ নগরে ঈশ্বরের এক মূর্তি প্ৰস্তুত করিয়ে পূজা করতেন। ঐ রাজার বংশজ মন্ত্রীর নাম সাংকুস্য। মন্ত্রীরাজ রাজধানী শাসনের ভার নিয়ে দুষ্ট দমন করে সাবধানে প্রজা পালন করতেন।
০২. শাক্যরাজার পুত্ৰ সুধন্য মহা তেজস্বী হয়ে সর্বদা ক্ষত্ৰিয়ভাবে রিপু দমন করে বীর ভাব প্রকাশ করে থাকতেন। সাংকুস্য মন্ত্রীর পুত্ৰ জয়ধন সেনাপতির সংগে মহারাজ সুধন্য যুদ্ধসজ্জায় সর্বদা সজ্জিত থাকতেন এবং শত্রু দমনে সাবধান থাকতেন। সুধন্য মহারাজের দুই রাণী, তিন পুত্র ছিল। বড়রাণীর গর্ভজাত গুণধন রাজভোগ পরিত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যোগসিদ্ধ হলেন। ছোট রানীর দুই পুত্ৰ-আনন্দমোহন, লাংগলধন। আনন্দমোহন সিদ্ধার্থের শিষ্য হয়ে রংবস্ত্র ধারণ করলেন।
০৩. দ্বিতীয় পুত্ৰ লাংগলধন রাজা হয়ে প্ৰজা পালন করতে লাগলেন। তিনি অল্পকাল রাজ্য শাসন করে জীবনলীলা শেষ করেন।
০৪. লাংলধনের পুত্র ক্ষুদ্রজিৎ কয়েক বৎসর প্রজাপালন করলেন। জয়ধন সেনাপতির পুত্ৰ সুবল, সুবলের পুত্র শ্যামল ও ক্ষুদ্রজিৎ রাজার মন্ত্রী ছিলেন।
০৫. ক্ষুদ্ৰজিতের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সমুদ্রজিৎ রাজা হন। তিনি শ্যামল মন্ত্রীর সাহায্যে কয়েক বৎসর রাজত্ব করেন। বিশ বৎসর বয়সে সমুদ্রজিৎ ভগবানের (গৌতম বুদ্ধ) উদ্দেশে যোগ কাৰ্য সাধন করে রংবস্ত্র ধারণে ভিক্ষু হলেন। তদবধি সেই রাজবংশ লুপ্ত হয়ে যায়।
০৬. শ্যামল মন্ত্রী কলাপ নগর পরিত্যাগ করে হিমালয়ের পূর্ব দক্ষিণাংশে নূতন রাজ্য স্থাপন করলেন। নূতন রাজধানীতে নানাবিদ পুষ্পোদ্যান, দীঘি, সরোবর, দেউল, মন্দির প্রস্তুত হল। সেই স্থানে শ্যামল রাজা হন।
০৭. চম্পকলী নামে তার পুত্র জন্মগ্রহণ করলেন। চম্পকলী রাজা হয়ে নিজ নামে ইরাবতী গংগার। পূর্বাংশে চম্পকনগর নামে পুরী খ্যাত করলেন। গংগার তীরে এক মন্দির প্রস্তুত করে ভগবানের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন।
০৮. চম্পকলীর পর তৎপুত্ৰ সাদাংগিরি নামে এক মহা পূণ্যবান রাজা হন। তিনি ভগবান উদেশে ভাবনা করে যোগসিদ্ধি করলেন। তিনি যোগতত্ত্বে সিদ্ধ হয়ে ব্ৰহ্মযোগে জ্ঞান অগ্নি জ্বেলে অজ্ঞান পাপদেহ অগ্নিদাহ করে পরমপদ প্ৰাপ্ত হলেন।
০৯. তৎপুত্র চেংগ্যসুর মহারাজা হয়ে ইষ্টক মন্দির প্রস্তুত করলেন এবং তন্মধ্যে ভগবানের বুদ্ধের মূর্তি সংস্থাপিত করলেন। সেই রাজার স্বজাতি দেশবাসীরা চেংগ্যসুর রাজার স্থাপিত ভগবানকে মিনতি পূর্বক পূজা করতে থাকেন। চেংগ্যসুর মহরাজের দুই পুত্র―ধর্মসুর, চান্দাসুর। চেংগ্যসুর বড় পুণ্যশালী হয়ে নানা পুণ্য উপাৰ্জন করতেন। জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ ধর্মসুর রাজকার্য পরিত্যাগ করে ভগবান উদ্দেশে ধর্ম অবলম্বন করে রংবস্ত্র ধারণ করলেন।
১০. দ্বিতীয় পুত্ৰ চান্দাসুর রাজা হয়ে শত্রু দমন করতে লাগলেন। চান্দাসুর মহারাজের তিন পুত্র-সুমেসুর, দেবসুর, বিম্বসুর।
১১. জ্যেষ্ঠ সুমেসুর রাজা হন। তৎপুত্ৰ ভীমজ্ঞয়।
১২. ভীমজ্ঞয় রাজা হয়ে মহাবীর, তেজস্বী হলেন। তিনি একাকী ঘোরবনে ভ্রমণ করে মৃগয়া করতেন। সিংহ, গণ্ডার, মহিষ, গয়াল ধরতেন। একদা তিনি কতেক সৈন্য নিয়ে হিমালয়ের পূর্বাংশে মৃগয়া করতে করতে ঘোরবনে প্রবেশ করলেন। মৃগ অন্বেষণে ভ্রমণ করতে করতে এক মহাগিরিশৃঙ্গে উঠলেন। গিরিশৃঙ্গের উপর এক মন্দির দেখলেন। মহারাজ স্বর্ণময় মন্দির দেখে সৈনিকদেরকে বললেন “এই মন্দিরে কোন দেবতা স্থাপিত আছে, খুলে দেখি।” মন্দির খুলে দেখলেন এক বুদ্ধের মূর্তি— তার জ্যোতিঃ সূৰ্যকিরণের ন্যায়। তাঁর সম্মুখে পাষাণে খোদিত কতেক বুদ্ধের মন্ত্র পেলেন। মহারাজ সেই মন্ত্রগুলি লিখে নিলেন। রাজা স্বর্ণময় মন্দিরে অমূল্য মন্ত্র পেয়ে স্বদেশে ফিরে আসলেন। রাজা ভীমজ্ঞয়ের পুত্ৰ সাম্বুদ্ধ।
১৩. সাম্বুদ্ধ রাজার দুই পুত্র―বিজয়গিরি ও উদয়গিরি।
১৪. রাজকুমার বিজয়গিরি চম্পকনগর হতে যাত্ৰা করে জলপথে ক্ৰমে ছয় দিন ছয় রাত্ৰি এসে তীরে উঠেছিলেন। তার সঙ্গে চারজন পণ্ডিত এবং ৭ চমু সৈন্য (প্রায় ২৬ হাজার) এসেছিলেন। বিজয়গিরি অল্প সৈন্যসহ “তেওয়া নদীতে।” কলাবাঘা প্রদেশে থাকলেন এবং সেনাপতিকে যুদ্ধ করার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। তদবধি বিজয়গিরির কোনো সংবাদ নেই। সেনাপতি ইন্দং বা ক্রিন্দং পাহাড়ে এবং টেকনাফে যুদ্ধ করেছিলেন। পক্ষান্তরের মত এই যে সেনাপতি যুদ্ধ জয় করে বিজয়গিরির নিকট দূত পঠাইলেন। সংবাদপ্রাপ্তে বিজয়গিরির বিজিত রাজ্যে পদার্পণ করে সেনাপতির সাক্ষাৎ করলেন এবং রাজ্য শাসনের শৃঙ্খলা বিধান করলেন। সেনাপতি স্বদেশে চলে গেলেন, বিজয়গিরি পরে ফিরবেন। বিজয়গিরি কলাবাঘা প্রদেশে পৌঁছলে শুনতে পেলেন তাঁর বৃদ্ধ পিতার কালপ্ৰাপ্তি হয়েছে এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতা উদয়গিরি অন্যায় মতে সিংহাসন আরোহণ করেছে। সে সংবাদ পেয়ে বিজয়গিরি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ত্যাগ করলেন এবং মনঃক্ষোভে বিজিত রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করে “আরি” মহিলা বিবাহ করলেন। বিজয়গিরি রাজার বংশ নেই। “চুইজং-ক্য-থাং” নামক ব্ৰহ্মা ইতিহাসে বর্ণিত আছে যে, তখন ব্ৰহ্মা সাম্রাজ্য তিন ভাগে বিভক্ত ছিল এবং তন্মধ্যে এক বিভাগ চাকমা রাজার অধীনে ছিল।
১৫. যুদ্ধে প্রেরিত চাকমাগণ হতে ধবল হাতী মাথায় ভুলে একজনকে রাজা করল। তার নাম সাকলিয়া (সকলের মনোনীত) রাজা হল। তার কোনো পুত্র ছিল না। তার কন্যা মাণিকী। মাণিকীর স্বামী বাঙ্গালীদের সাথে মিলিত হয়ে মঘীদের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করেছিল। এই জন্য তার নাম বাঙ্গালী সর্দার হল। রোয়াং দেশে এই যুদ্ধ হয়েছিল। আরাকানের ইতিহাস “দেংগ্যাওয়াদি আরেদফুং” নামক গ্রন্থে ১৭-১৯ পৃষ্ঠাতে বর্ণিত আছে যে এই সকল রোয়াং দেশের যুদ্ধ ১১১৮-১৯ খৃষ্টাব্দে হয়েছিল।
১৬. মাণিকীর পুত্ৰ মাণিক পেয়ে মাণিক গিরি রাজা হন।
১৭. মাণিক গিরির পুত্র মাদালিয়া রাজা হন।
১৮. মাদালিয়ার পুত্র রামা থংজা রাজা হন।
১৯. রামা থংজার পুত্ৰ কমলচোগে রাজা হন। কমলচোগের সময়ে রুয়াং দেশে (আরকান) যুদ্ধ হয়েছিল এবং চাকমারা রুয়াং দেশে যায়।
২০. কমলচোগের পুত্র রতনগিরি রাজা হন।
২১. রতনগিরির পুত্ৰ কালা থংজা রাজা হন।
২২. কালা থংজার পুত্র চক্রধান রাজা হন।
২৩. চক্ৰধনের পুত্ৰ চেইলা ধাবেং রাজা হন।
২৪. চেইলা ধাবেং-এর পুত্র সেরামত্যা রাজা হন। তার সময়ে রাধামোহনের সেনাপতিত্ত্বে রোয়াং হতে অক্সা (ব্ৰহ্মা) দেশে গিয়ে চাকমারা যুদ্ধ করেছিল। চাটিগাঁ ছরাগীতির এই সময়ে উৎপত্তি।
২৫. সেরমত্যর পুত্র অরনজুগ রাজা হন। তিনি মঘীদের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করেছিলেন। অরনজুগের তিন পুত্র ও দুই কন্যা। মঘ রাজা অরনজুগ ও তাঁর পুত্ৰ-কন্যাগণকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। জ্যেষ্ঠ দুই রাজকুমারকে মঘেরা অন্য দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
২৬. তৃতীয় রাজকুমারকে জল বেপারীর টেক্স উগুলকাৰ্যে মঘ রাজা হিসেবে নিযুক্ত করেন। এই জন্য তাঁর নাম “ঘাট্যা” বা “ঘাগট্যা” রাজা। জ্যেষ্ঠ রাজকুমারী সোনাবীকে মঘ রাজা বিবাহ করলেন, দ্বিতীয়া রাজকুমারীকে মঘ রাজার পাত্রে বিবাহ করেন। ঐ রাজকুমারীরা যে যে দেশে রইলেন―‘তাঁদের নামে সোনাপুর ও মাণিকপুর বলে জায়গায় নাম হল।
২৭. ঘাগট্যা রাজার পুত্র, মাইশাং রাজা হন। মইশাং রাজা খাজানা দেওয়ার ভয়ে মইশাং হন। এই জন্য তার নাম মইশাং রাজা হয়েছিল। এই রাজার সময়ে মঘের দৌরাত্ম্য সহ্য করতে না পেরে চাকমারা পালিয়ে আসতে পরামর্শ করল। মইশাং রাজা সম্বন্ধে একটা গান আছে―
“এলে মইশাং লালস নেই, ন এলে মইশাং কেলেশ নেই”। অর্থাৎ ঐ রাজা প্রজাদের সঙ্গে আসলেও যা, না আসলেও তা।
২৮. মইশাং রাজার পুত্রের নাম মারিক্যা। মারিক্যা রাজার সময়ে চাকমারা রোয়াং দেশ হতে পালিয়ে আসে এবং কদমতলীতে বস্তি করে।
২৯. সে জন্য জায়গায় নামে মারিক্যা রাজার পুত্রের কদমথংজা নাম হল।
৩০. কদমথংজার পুত্র রদংসা রাজা হন।
৩১. রদংসার পুত্র তিন সুরেশ্বরী রাজা হন।
৩২. তিন সুরেশ্বরীর পুত্র রাজা হন জনু। রাজার সেনাপতি রণ পাগালা মঘের সাথে তৈনছরাতে অনেক যুদ্ধ করেছিলেন। জনু রাজার পুত্র ছিল না―শুধু দুই কন্যা। জনু রাজা ১২০ বৎসর পৰ্যন্ত জীবিত ছিলেন। বড় কন্যা সাজোম্বীকে মঘ রাজা বিবাহ করে। দ্বিতীয় কন্যা রাজেস্বীকে বুড়া বড়ুয়া বিবাহ করেন।
৩৩. বুড়া বড়ুয়ার পুত্র সাত্তুয়ারাজা হন। তিনি পরে পাগলা রাজা বলে প্ৰসিদ্ধ হন। পাগলা রাজা অতিশয় জ্ঞানী ছিলেন। কথিত আছে মন্ত্র বলে তিনি চিৎকলিজা বের করে ধৌত করে আবার ঢুকিয়ে রাখতেন। এই কার্য করতে তাঁর রাণী উকি দিয়ে দেখলে, তিনি আর ঢুকাতে পারলেন না। তাঁতে প্রকৃতপাগল হন। যাকে তাকে কাটতে লাগলেন। সেজন্য তার রাণীর সম্মতিতে তাকে হত্যা করা হয়। প্ৰবাদ আছে। তিনি একদিন টংগীতে বসেছিলেন এবং জংগলী হাতী এসেছে বলে পূর্ব প্ৰস্তাব মতে মিথ্যা রটনা করাতে বন্য হাতী দেখবার জন্য মাথা বের করলেন। তখন পেছনদিক হতে তার শিরচ্ছেদ করা হয়। তাঁর পুত্ৰ চনন খাঁ রতন খাকেও নিহত করা হয়।
৩৪. পাগলা রাজার মৃত্যুর পর রাণী রাজকাৰ্য চালান। “কাটুয়া কন্যার” আমল বলে তার দুর্নাম রটেছিল। পাগলা রাজার কন্যা অমংগলী। অমংগলীর স্বামীর নাম মুলিমা থংজা।
৩৫. তৈনছারার মুখে বংশ-সিংহাসন স্থাপিত করে ধুর্যা, কুর্যা, ধাবানা, পীড়াভাঙ্গা এই চার জনের মধ্যে প্রত্যুষে উঠে ঐ সিংহাসনে আরোহণ করাতে ধাবানা রাজা হন। ধাবানা রাজকন্যা অমংগলীর গর্ভজাত। রাজা হওয়ার এটাও প্রধান কারণ। পীড়াভাঙ্গা নামে অমংগলীর আর এক পুত্র ছিল। ধাবানা রাজার সময়ে কালা সুরেশ্বরী প্রধান যোদ্ধা ছিল।
৩৬. ধাবানার পুত্র ধরম্যা রাজা হন।
৩৭. ধরম্যার পুত্র মোগল্য রাজা হন। মোগাল্যার দুই পুত্ৰ যুবল খাঁ, ফতে খাঁ।
৩৮. রাজা যুবল খাঁর সময়ে অনেক যুদ্ধ হয়েছিল। রাজার সেনাপতি কালু খাঁ সৰ্দার মুসলমান নবাবের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধে বড় বড় দুইটা কামান শত্রু গণ হতে অধিগত করে আনা হয়েছিল। কালু খাঁ ও রাজার ভ্রাতা ফতে খাঁর নামে ঐ দুই কামানের নাম রাখা হয়। যুবল খাঁ অল্প বয়সে মারা যান। সন্তানাদি ছিল না।
৩৯. যুবল খাঁর মৃত্যুর পদ তদীয় ভ্রাতা ফতে খাঁ রাজা হন। ১৭১৩ খ্ৰীষ্টাব্দে ফতে খাঁ নবাবের সাথে সন্ধি করেন এবং বার্ষিক এগার মণ কার্পাস খাজনা দিতে স্বীকৃত হন। রাজা ফতে খাঁর নামে ফতে খাঁর চর (কাপ্তাইর একটু উপরে) হয় ফতে খাঁর তিন পুত্র-সেরমস্ত খাঁ, রহমত খাঁ, সের্জন খাঁ।
৪০. সেরামস্ত খাঁ রাজা হন। তার সময়ে চট্টগ্রাম চিফ মি. হেনরী ভেরেলেষ্ট ঘোষণা করেন যে নিজামপুর রাস্তা ও কুকী রাজ্যের এবং ফেণী নদী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থান চাকমা রাজার রাজ্যভুক্ত।
৪১. সেরমস্ত খাঁর কোন সন্তানাদি ছিল না। তিনি শুকদেবকে পোষ্য গ্ৰহণ করেন। শুকদেব রাজা হয়ে শুকদেব তরফ বন্দোবন্তী করেন। শুকদেব নিঃসন্তান অবস্থায় মারা পড়েন। শুকদেবের সময় ধুংগি লস্কর ও বাঙ্গালী লম্ফর ছিল।
৪২. রাজা ফতে খাঁর দ্বিতীয় পুত্র রহমত খাঁর পুত্রের নাম সের দৌলত খা। শুকদেবের মৃত্যুর পর সের দৌলত খাঁ ১৭৭৬ খ্ৰীষ্টাব্দে রাজা হন। সেরা দৌলত খ্যার সময়ে ইংরেজ গবর্ণমেন্টের সাথে যুদ্ধ হয়। ইংরেজ গবৰ্ণমেণ্ট মি. লেন ও মি. ওটরমারের নেতৃত্বাধীনে দুইবার অভিযান পাঠিয়েও কোন ফলোদয় হয়নি। সেরদৌলতের পুত্ৰ জানবক্স খাঁ।
৪৩. ১৭৮২ খ্রী, ১১১৪ মঘীতে জানবক্স খাঁ রাজা হন। ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্টের সাথে। ১৭৮৩, ১৭৮৪, ১৭৮৫ খ্ৰীষ্টাব্দে যুদ্ধ করেন, যে যুদ্ধটি "চাকমা বিদ্রোহ" নামে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। তৎভগ্নিপতি রণু খাঁ দেওয়ান ইচ্ছামতি মুখে মুখে, ধুরুংখালে রাণু দেওয়ান এবং হাজারীবাকে নারাণ দেওয়ার সেনাপতি ছিলেন। জানবক্স খাঁ পার্বত্য অভ্যন্তরে মহাপ্ৰক্ৰমে আশ্রয় লন। তৎকালে এক গর্ভবতী রমণী পলায়ন কালে শারীরিক ক্লেশ সহ্য করতে না পেরে রাজাকে উল্লেখ করে গালী দিয়েছিল। রাজা তা দৈবক্রমে শুনতে পান। তৎপর তিনি কলিকাতা গিয়ে ১৭৮৭ খ্ৰী, গবৰ্ণর জেনেরোলের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং বার্ষিক ৫শত মণ কার্পাস দেওয়ার চুক্তিতে গবৰ্ণমেণ্টের সাথে সন্ধি হয়। কথিত আছে প্ৰসিদ্ধ জমিদার ঘোষাল পরিবার তাকে অত্যন্ত সাহায্য করেছিলেন। জানবক্স খাঁর তিনপুত্র-টকবর খাঁ, জব্বর খাঁ, ও দুলা।
৪৪. জানবক্স খাঁর মৃত্যুর পর তৎজ্যেষ্ঠ পুত্র টকবর খাঁ রাজা হন। তিনি রাজানগরের এক সাগর (মহামুনি দীঘি নহে) খনন করিয়েছিলেন। টকবর খাঁ নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান।

৪৫. রাজা টব্বর খাঁর মৃত্যুর পর তদীয় ভ্রাতা জব্বর খাঁ রাজা হন। জব্বর খাঁর কনিষ্ঠ ডোলাপেটা রাজা হননি।
৪৬. রাজবংশের কুলপ্ৰথা মতে জব্বর খাঁর মৃত্যুর পর তদীয় পুত্ৰ ধরমবক্স খাঁ ১৮১২ খ্রী, রাজা হন। মহারাজা চট্টগ্রামের প্ৰসিদ্ধ ভট্টাচাৰ্য বংশ হতে হিন্দুর মন্ত্র গ্রহণ করেন ও মহারাজা ভট্টাচাৰ্য উপাধি এবং বিপুল ব্ৰহ্মোত্তর দান করে যান। ধরমবক্স খাঁর তিন রাণী―কালা প্রকাশ-কালিন্দী রাণী, দ্বিতীয়া আটক, তৃতীয় হাড়ি। তৃতীয়ার গর্ভে এক কন্যা জনে-মেনকা। তার সাথে গোপীনাথ দেওয়ানের বিবাহ হয়। তাদের প্রথম পুত্র হরিশ্চন্দ্ৰ। মহারাজ ধরমবক্সের মুলিমা গোজা শুকলাল দেওয়ান সরবরাহকার নিযুক্ত হন।
 কিন্তু তার দ্বারা সুশাসন না হওয়াতে, কালিন্দী রাণী স্বয়ং রাজ্যভার গ্রহণ করেন। কালিন্দী রাণীর প্রতি সবিশেষ শ্রদ্ধা থাকাতে, গবৰ্ণমেণ্ট পুনঃ পুনঃ পীড়াপীড়ি করাতে ও হরিশ্চন্দ্রের সাবালক হয়েও রাজ্যভার গ্ৰহণ করলেন না। কালিন্দী রাণী জমিদারী সুশাসন করেন, বৃদ্ধি করেন এবং মহামুনির মন্দির নির্মাণ, মহামুনির বার্ষিক মেলা স্থাপন মহামুনির দীঘি খনন ইত্যাদি নানাবিধ পুণ্যকার্য করে অমর হয়ে রয়েছেন। সিপাহী বিদ্রোহকালে যে সকল সিপাহী পর্বতে আশ্রয় নিয়েছিল, রাণী তাদেরকে ধূত করে গবর্ণমেণ্টর হস্তে অৰ্পণ করেন। ১৮৭২ খ্ৰী, লুসাই অভিযানে তিনি তার দৌহিত্র হরিশ্চন্দ্ৰকে গবৰ্ণমেন্টের সাহায্য করার জন্য যুদ্ধে পাঠিয়ে দেন। হরিশ্চন্দ্র সেজন্য রায়বাহাদুর উপাধি এবং ১,৫০০ টাকা মূল্যের সোনার ঘড়ী ও চেন গবর্ণমেণ্ট হতে উপহার পান।
৪৭. কালিন্দী রাণীর স্বাগারোহণের পর ১৮৭৩ খ্রী, হরিশ্চন্দ্র রাজা হন। তাকে রাজানগর ত্যাগ করে রাংগামাটি স্বপ্ৰজার মধ্যে বাস করতে গবৰ্ণমেণ্ট বাধ্য করেন। রাজার দুই রাণীর গর্ভে দুই পুত্ৰ-জ্যেষ্ঠা রাণীর গর্ভে কুমার ভুবনমোহন, কনিষ্ঠ রাণীর গর্ভে কুমার রমণীমোহন।
৪৮. রাজা হরিশ্চন্দ্রের মৃত্যুর পর ১৮৮৫ খ্ৰী. তার জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ যুবরাজ ভুবনমোহন নাবালক থাকাতে রাজ্য ও জমিদারী কোর্ট-অব-ওয়ার্ডস কর্তৃক শাসিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজ্যে রায়সাহেব কৃষ্টচন্দ্র দেওয়ান লৌহ শাসনে দুৰ্দ্ধৰ্ষ চাকমা। জাতিকে শাসন করে বিশেষ নাম অর্জন করেছিলেন। বয়োপ্রাপ্ত হলে ১৮৯৭ খ্ৰী যুবরাজ ভুবনমোহন রাজা হন।
৪৯. রাজা ভুবন মোহন রায়ের মৃত্যুর পর যুবরাজ নলিনাক্ষ রায় ১৯৩৫ ইংরেজীর ৭ই মার্চ, বিভাগীয় কমিশনার মিঃ টুইনাম আই, সি, এস মহোদয় কর্তৃক রাজা গদীতে অভিষিক্ত হন। রাজা নলিনাক্ষ রায় বি, এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া ইংরেজী সাহিত্য এম এ পর্যন্ত অধ্যায়ন করেন। রাজ কুমার বিরূপাক্ষ রায় ডিস্ট্রিক্ট কন্ট্রোলার হিসাবে চাকুরী করিয়া অবসর গ্রহন করেন। তিনি গভর্ণমেন্ট প্রদত্ত রায় বাহাদুর উপাধী প্রাপ্ত হন। রাজা নলিনাক্ষ রায় মাত্র ১৬ বৎসর রাজত্ব করেন। ১৯৩৯ ইং ৮জুন সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের জন্ম দিবস উপলক্ষে সম্রাট জয়ন্তীতে তাঁহাকে ‘রাজা’ উপাধী প্রদান করা হয়। রাণী বিনীতা দেবী একজন সাহিত্য সেবী ও সশিক্ষিতা মহিলা। তাঁহারাই আগ্রহে ও সাহায্যে পার্বত্যচট্টগ্রামের একমাত্র পত্রিকা । "গৈরিকা” একসময় পরিচালিত হইয়াছিল। রাজা নলিনাক্ষ রায়ের সময়ে ১৯৪৭ ইং ১৪ আগষ্ট পাকিষ্ঠান স্বাধীনতা লাভ করে। বিগত ১৯৫১ইং ৭ অক্টোবর তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
৫০. ত্রিদিব রায় ১৯৩৩ সালের ১৪ মে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে চাকমা রাজপ্রাসাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজা নলিনাক্ষ রায় ও রানী বিনিতা রায়ের ছেলে। ত্রিদিব রায় লন্ডনের ইনস অব কোর্টে আইন বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে তিনি ব্যারিস্টার-এট-ল হন। তিনি লিঙ্কনস ইনের সদস্য ছিলেন। রাজা নলিনাক্ষের মৃত্যুর পর ১৯৫৩ সালের ২ মে ত্রিদিব রায় চাকমা সার্কেলের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন। ১৯৭১ সালে তিনি দায়িত্ব ত্যাগ করেন। এরপর তার ছেলে বর্তমান চাকমা সার্কেলের রাজা দেবাশীষ রায় ৫১ তম রাজা হন। রাজা ত্রিদিপ রায় পাকিস্তানে তিনি একজন লেখক, কূটনৈতিক, বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা ও রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। ১৯৮১ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি আর্জেন্টিনায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। পাকিস্তান সরকার তাকে আজীবন মন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করে। ত্রিদিব রায় ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মারা যান।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চাকমাদের খাঁ, রায়, খীসা, দেওয়ান ও তালুকদার উপাধি

নিঝুম তালুকদার আমি পুর্বের আলোচনাতে চাকমা রাজ বংশের বংশানুক্রমিক ও পিরি নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আর নতুন করে সে বিষয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন নেই। তাই সংক্ষেপে আলোচনা শুরু করছি। সবাই সাথে থাকুন। পড়তে থাকুন। জনু রাজার পুত্র ছিল না―শুধু দুই কন্যা। জনু রাজা ১২০ বৎসর পৰ্যন্ত জীবিত ছিলেন। বড় কন্যা সাজোম্বীকে মগ রাজা বিবাহ করে। দ্বিতীয় কন্যা রাজেস্বীকে বুড়া বড়ুয়া বিবাহ করেন। বুড়া বড়ুয়ার পুত্র সাত্তুয়া রাজা হন। তিনি পরে পাগলা রাজা বলে প্ৰসিদ্ধ হন। পাগলা রাজা অতিশয় জ্ঞানী ছিলেন। কথিত আছে মন্ত্র বলে তিনি চিৎকলিজা বের করে ধৌত করে আবার ঢুকিয়ে রাখতেন। এই কার্য করতে তাঁর রাণী উকি দিয়ে দেখলে, তিনি আর ঢুকাতে পারলেন না। তাঁতে প্রকৃত পাগল হন। যাকে তাকে কাটতে লাগলেন। সেজন্য তার রাণীর সম্মতিতে তাকে হত্যা করা হয়।  প্ৰবাদ আছে- "তিনি একদিন টংগীতে বসেছিলেন এবং জংগলী হাতী এসেছে বলে পূর্ব প্ৰস্তাব মতে মিথ্যা রটনা করাতে বন্য হাতী দেখবার জন্য মাথা বের করলেন। তখন পেছনদিক হতে তার শিরচ্ছেদ করা হয়।" পাগলা রাজার মৃত্যুর পর রাণী রাজকাৰ্য চালান। “কাটুয়া কন্যার” আমল বলে তার দুর্না

কাপ্তাই বাঁধ ও রড়পোরং

নিঝুম তালুকদার কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ পার্বত্যঞ্চলের এক বেদনাদায়ক যুগান্তকারী ঘটনা। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে এই বাঁধ নির্মাণ এই অঞ্চলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়। বিষয়টি এখনও বির্তকিত রয়েছে। পৃথিবীর অনেক আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে উন্নয়নের নামে যে সব প্রকল্প ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বির্পযয় ও বিলুপ্তির জন্য দায়ী কাপ্তাই বাঁধ তন্মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এই বাঁধ অত্রাঞ্চলে পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক বিপর্যয়।  পার্বত্য অঞ্চলের জৈব্য বৈচিত্র্য, পরিবেশ ধ্বংস ছাড়াও চাকমা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকজনকে বিলুপ্তির কাছাকাছি এনেছে কাপ্তাই বাঁধ। কাপ্তাই বাঁধ পার্বত্যঞ্চলের জনগণের তথা চাকমা জনগোষ্ঠীর দূর্গতির মূল কারণ। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নের নামে নির্মিত এই বাঁধ পার্বত্য অঞ্চলের অন্যতম আদিবাসী জনগোষ্ঠী চাকমা সম্প্রদায়কে বিলুপ্তি ও ধ্বংসের প্রান্তে এনেছে। আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে এই বাঁধ নির্মিত হলেও এর বিরুপ প্রভাব এখনও বিদ্যমান। ভৌগলিক, পরিবেশগত ও জৈব্য বৈচিত্র্যের উপর এর অবর্ণনীয় ক্ষতিকর প্রভাব হাজার বছরব্যাপী অত্রাঞ্চলে বিরাজ করবে। বাঁধ নির্মাণ কার্য যারা প্রত্যক্ষ

চাকমা জাতির এক মহীয়সী নারী চাকমা রাণী কালিন্দী

 ইলিরা দেওয়ান চাকমা রানী কালিন্দী কে নিয়ে সকলের মুখে প্রায়ই শোনা যায় যে চাকমা রাণী কালিন্দীর কারনে চাকমা জাতি রাজ্যহারা। তারই ভুলের জলন্ত আগুনের মশালে দহনীয় সমগ্র চাকমা জাতি। রাণী কালিন্দীর বিরদ্ধে সবার মাঝে যে ধারনা সেই বিষয় নিয়ে আজকের সংক্ষিপ্ত আলোচনা । সবাই সাথে থাকুন। পড়তে থাকুন।  বৃটিশ আমলে উপমহাদেশের মহীয়সী নারীদের বীরত্ব গাঁথা কিংবা সমাজে তাঁদের অবদানের কথা বললে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে নবাব ফয়জুন্নেসা, বেগম রোকেয়াদের কথা। কিন্তু তাঁদের জন্মেরও পূর্বে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আরেক মহীয়সী নারীর কথা ক’জনইবা জানেন! উনিশ শতকের প্রথমদিকে রাস্তাঘাটহীন দূর্গম পার্বত্য এলাকার কুদুকছড়ির সাধারণ এক চাকমা জুমিয়া পরিবারে জন্মেছিলেন কালাবি চাকমা। পরবর্তীতে চাকমা রাজা ধরম বক্স খাঁ এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তিনি ‘কালিন্দী রাণী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠলেও তিনি স্বশিতি ছিলেন এবং তাঁর প্রাজ্ঞ দিয়ে রাজপরিবারের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে সম হয়েছিলেন। কালিন্দী রাণী শুধু বৈষয়িক বুদ্ধিতে কিংবা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দূরদর্শিতায় প্রাজ্ঞ ছিলেন না, এর পা

চাকমা রাজবংশের ইতিহাস (২য় পর্ব)

নিঝুম তালুকদার যা গতকালকের আলোচনায় আজুর সত্যি ঘটনার গল্পের কাহিনীতে "চাকোমাস" নামে যে চাকমাদের রাজ্যের নামটি উল্লেখ করা হয়েছিল সেটির ইতিহাস সুত্র ধরে আজুর সত্য ঘটনার গল্পের কাহিনীর সাথে অনেকের ইতিহাস লেখকের লেখা কাহিনীর সাথে মিল পেয়েছি। কারণ বহু লেখক লিখেছেন চাকমাদের রাজ্যের নাম "চাকোমাস"। এবং কিছু কিছু ঘটনাবলীও অনেক মিল রয়েছে। আরো একটি কাহিনী মিলিয়ে দেখুন।  চাকমা রাজপরিবার লিখেছেন-- সুশীল প্রসাদ চাকমা , রাঙ্গামাটি তিনি যা যা লিখেছেন সেগুলোর কপি দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসের সূত্র মতে, হিমালয়ের পাদদেশে শাক্য নামে এক রাজা বাস করতেন। তার রাজধানী ছিল কালপ্পানগর। সেখানে ঈশ্বরের মূর্তি তৈরি করে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন তিনি। যানকুনী মন্ত্রীর জন্ম ওই পরিবারে। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে রাজ্য চালানোর জন্য তার খ্যাতি ছিল ব্যাপক। সুধন্য নামে শাক্য রাজার ছিলেন এক সাহসী ছেলে। তিনি ক্ষত্রীয় বীরদের মতো শত্রুদের দমন করতেন। রাজা সুধন্যর দুই রাণী ও তিন পুত্র সন্তান ছিল। প্রথম রাণীর ছেলে গুণধর রাজকীয় আনন্দ ত্যাগ করে মোহমুক্তির উদ্দেশ্যে সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করেন। কনিষ্ঠ রাণীর আনন্

চাকমা রাজবংশের ইতিহাস

নিঝুম তালুকদার আমরা তখন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরনার্থী অবস্থায় ছিলাম। সেখানে অনেক ছেলে- মেয়েকে আমার আজু প্রায়ই গল্প শুনাতেন। একদিন আজু আজকের আলোচনা বিষয়টি সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক সত্য ঘটনার গল্প বলেছিলেন। আজু যে ভাবে বলেছিলেন ঠিক সেইভাবে ঐ ঘটনার কথা নিয়ে আজকে আলোচনা করতে যাচ্ছি। সবাই সাথে থাকুন। চাকমা রাজপরিবার ইতিহাস অনুসারে সময়টা আনুমানিক ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগ। চম্পক নগরের রাজা সাংবুদ্ধ। সাংবুদ্ধর দুই ছেলে- বড় ছেলের নাম বিজয়গিরি এবং ছোট ছেলের নাম সমরগিরি। যুবরাজ বিজয়গিরি যুদ্ধবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। ছেলেবেলা হতেই তিনি রাজ্য জয় ও রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখতেন। চম্পক নগরের ভাবি রাজা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন।  ত্রিপুরার দক্ষিনে অবস্থিত মগ রাজ্য। মগরা ছিল দুস্য প্রকৃতির। তারা শহর ও গ্রামে লুন্ঠণ এবং মানুষের ওপর অত্যাচার করে বেড়াত । ত্রিপুরা রাজের অধিভূক্ত দক্ষিনাঞ্চলেও তাদের দৌরাত্ম্য থেকে মুক্ত ছিল না । এসময় ত্রিপুরা রাজ্যে অন্তঃবিপ্লবের সম্ভাবনা থাকায় রাজা মগদের দমনে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেনি। যুবরাজ বিজয়গিরি তার সামরিক অভিযানের

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও ইতিহাস

নিঝুম তালুকদার আদিবাসী প্রসঙ্গ বস্তুতঃ বাংলাদেশে ‘ইন্ডিজেনাস’ বা ‘আদিবাসী’ কারা তা একটি মীমাংসিত বিষয়। কিন্তু তারপরও সরকার ও বাঙালী জাত্যাভিমানী-সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন একটি গোষ্ঠী জেনেও না জানার ভান করে আদিবাসী নিয়ে বিতর্কের অবতাড়না করছে। বিষয়টিকে জটিল রূপ দিয়েছে। ‘আদিবাসী’ বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল বা বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে সরকার আদিবাসীদের ন্যায্য অধিকারকে অস্বীকার করতে চাইছে অথবা তার দায়দায়িত্ব থেকে সরে যেতে চাইছে। অন্য কোন দেশে এমন হয়নি। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ এবং গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তি বলে দাবীদার আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছে। আবার বলা যেতে পারে, সরকার বর্তমানে আদিবাসী বিষয়ে ও আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে বা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। অথবা আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে সরকার যে চরম রক্ষণশীল, এমনকী প্রতিক্রিয়াশীল- তার মুখোশই উন্মোচিত হয়েছে। এ জন্য এই সরকারকে একদিন মাশুল দিতে হবে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের আদিবাসীরা হুট করে নিজেরাই নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ বলে দাবী করে বসেনি। জাতিসংঘ

জুম্মবির অতীত কথা ও স্মৃতি

তারাচরন চাকমা জুম্মবিতে লেখার, বলার ও প্রকাশ করতে সাহজ ও উৎসাহ দিয়ে সবসময়  সাথে থাকবেন। জুম্ম ঘরে জন্ম হওয়াতে তার নাম জুম্মবি। জুম্মবির তেরোটি জাতি সত্বার দশ ভাষার ছোট একটি দেশ জুম্ম দেশ। দশ ভাষায় কথা বলাতে তাকে ভাষাবিও ডাকা হয়। চার দিকে সবুজ সবুজ মুড়ো ও পাহাড় নিয়ে জুম্মবির জুম্মদেশে প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সাইনো তিব্বতী মঙ্গোলয়ড ১৩ টি জাতিগোষ্ঠী এখানে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেছে। প্রায় ৫,০০,০০ (পাঁচ লক্ষ)জনসংখ্যার অভিবাসী জুম্মজাতি প্রধান দু'টি হলো চাকমা এবং মারমা। এরা ছাড়াও আছে ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, পাংখো, ম্রো, খিয়াং, বম,খুমি, চাক,গুর্খা, আসাম। খুব সুখে ছিল সেখাানে তারা। জুম্মবির জুম্মদেশে দশ ভাষা ভাষি তেরোটি জাতি ছাড়া অন্য কোন জাতি ছিল না। ১৫৫০ সালের দিকে প্রণীত বাংলার প্রথম মানচিত্রে বিদ্যমান ছিল। তবে এর প্রায় ৬০০ বছর আগে ৯৫৩ সালে মগধের চম্পক নগরের রাজা উদয় গিরি এই অঞ্চল অধিকার করেন। ১২৪০ সালের দিকে ত্রিপুরার রাজা এই এলাকা দখল করেন। ১৫৭৫ সালে আরাকানের রাজা এই এলাকা পুনর্দখল করেন, এবং ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত অধিকারে রাখেন। মুঘ

বৃটিশ শাসনে চাকমা জনগোষ্ঠীর সম্পাদনা

নিঝুম তালুকদার পলাশীর যুদ্ধের তিন বছর পরে, মুর্শিদাবাদের নতুন নবাব মীর কাশিম বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে চট্টগ্রাম বর্ধমান এবং মেদিনীপুর উপহার হিসেবে দিয়ে দেন। যেটি গতকাল আলোচনায় বলা হয়েছে। দিনটি ছিল ৫ জানুয়ারী ১৭৬১ সালে, কোম্পানীর প্রতিনিধি হ্যারি ভেরেলস্ট চট্টগ্রামের শাসনভার সুবেদার মোহাম্মদ রেজা খানের কাছ থেকে গ্রহন করেন। তবে তখনো চাকমা রাজা শের দৌলত খান স্বাধীনভাবে তার রাজ্য পরিচালনা এবং মুঘলদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। এবং কোম্পানীর শাসন মেনে না নিয়ে কোম্পানী কর্তৃক ধার্য নির্ধারিত খাজনা প্রদানে বিরত ছিলেন। ফলে কোম্পানির সাথে একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের সূত্রপাত হয়, যা ১৭৮৭ সালপর্যন্ত চলেছিল। কোম্পানী চাকমা রাজের বিরুদ্ধে চারটি যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। সেগুলো হল - ১৭৭০, ১৭৮০, ১৭৮২ এবং ১৭৮৫ সালের যুদ্ধ। যুদ্ধে কোম্পানী বিশেষ সুবিধে করতে না পারায় এবং চাকমা রাজ্যে বাণিজ্য অবরোধের ফলে সৃষ্ট সমস্যায় - দুই পক্ষই ১৭৮৫ সালে একটি শান্তি আলোচনা চালায়। চাকমা রাজের পক্ষে রাজা জানবক্স খান, শের দৌলত খানের পুত্র অংশ নেন। পরবর্তীতে ১৭৮৭ সালে কলকাতায় চাকমা রাজের সাথে কোম্প