নিঝুম তালুকদার আদিবাসী প্রসঙ্গ বস্তুতঃ বাংলাদেশে ‘ইন্ডিজেনাস’ বা ‘আদিবাসী’ কারা তা একটি মীমাংসিত বিষয়। কিন্তু তারপরও সরকার ও বাঙালী জাত্যাভিমানী-সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন একটি গোষ্ঠী জেনেও না জানার ভান করে আদিবাসী নিয়ে বিতর্কের অবতাড়না করছে। বিষয়টিকে জটিল রূপ দিয়েছে। ‘আদিবাসী’ বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল বা বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে সরকার আদিবাসীদের ন্যায্য অধিকারকে অস্বীকার করতে চাইছে অথবা তার দায়দায়িত্ব থেকে সরে যেতে চাইছে। অন্য কোন দেশে এমন হয়নি। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ এবং গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তি বলে দাবীদার আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছে। আবার বলা যেতে পারে, সরকার বর্তমানে আদিবাসী বিষয়ে ও আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে বা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। অথবা আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে সরকার যে চরম রক্ষণশীল, এমনকী প্রতিক্রিয়াশীল- তার মুখোশই উন্মোচিত হয়েছে। এ জন্য এই সরকারকে একদিন মাশুল দিতে হবে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের আদিবাসীরা হুট করে নিজেরাই নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ বলে দাবী করে বসেনি। জাতিসংঘ...
নিঝুম তালুকদার
কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ পার্বত্যঞ্চলের এক বেদনাদায়ক যুগান্তকারী ঘটনা। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে এই বাঁধ নির্মাণ এই অঞ্চলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়। বিষয়টি এখনও বির্তকিত রয়েছে। পৃথিবীর অনেক আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে উন্নয়নের নামে যে সব প্রকল্প ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বির্পযয় ও বিলুপ্তির জন্য দায়ী কাপ্তাই বাঁধ তন্মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এই বাঁধ অত্রাঞ্চলে পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
পার্বত্য অঞ্চলের জৈব্য বৈচিত্র্য, পরিবেশ ধ্বংস ছাড়াও চাকমা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকজনকে বিলুপ্তির কাছাকাছি এনেছে কাপ্তাই বাঁধ। কাপ্তাই বাঁধ পার্বত্যঞ্চলের জনগণের তথা চাকমা জনগোষ্ঠীর দূর্গতির মূল কারণ। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নের নামে নির্মিত এই বাঁধ পার্বত্য অঞ্চলের অন্যতম আদিবাসী জনগোষ্ঠী চাকমা সম্প্রদায়কে বিলুপ্তি ও ধ্বংসের প্রান্তে এনেছে। আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে এই বাঁধ নির্মিত হলেও এর বিরুপ প্রভাব এখনও বিদ্যমান। ভৌগলিক, পরিবেশগত ও জৈব্য বৈচিত্র্যের উপর এর অবর্ণনীয় ক্ষতিকর প্রভাব হাজার বছরব্যাপী অত্রাঞ্চলে বিরাজ করবে। বাঁধ নির্মাণ কার্য যারা প্রত্যক্ষ করেছে কিংবা বাঁধ নির্মাণের ফলে যারা উচ্ছেদ হয়েছে, যারা তাদের পিতৃভূমি জনপদ থেকে স্থানান্তরিত, যারা শারিরীক, মানসিক ও আর্থিকভাবে অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি ও অপরিমেয় দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছে সে সব প্রজন্মের অধিকাংশ লোকজন আচে নেই। আর যারা বেঁচে আছেন তাদের অধিকাংশের বয়স এখন ষাটের উপর থেকে সত্তর-আশির কোঠায়। বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশ লোকজনের যাদের বয়স এখনও পঞ্চাশের নিচে তাদের কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ পূর্বকালীন পার্বত্যঞ্চলের সেই হারিয়ে যাওয়া সোনালী দিনগুলো প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়নি। তাদের অধিকাংশেরই জন্ম নতুন পুনর্বাসন এলাকায়। তারা হয়তো অনেকেই তাদের নিকট আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব যারা বয়সে প্রবীণ তাদের নিকট থেকে তৎকালীন পার্বত্য অঞ্চলের সুদিনের কথা সামান্য শুনে থাকবে। তাই বর্তমান প্রজন্মের সময় হয়েছে অতীতকে জানার ও উপলব্ধি করার। আমাদের সেকালের জনগণের অবস্থা কেমন ছিল, পার্বত্য অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক, ভৌগলিক ও পরিবেশগত অবস্থা পরিবর্তনের কারণসমূহ, আমাদের হারিয়ে যাওয়া অতীত কেমন ছিল, কিভাবে পিতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ ও বাস্তুচ্যুত হলাম এসব কৌতুহল হয়তো অনেকেরই জানার আকাঙ্খা রয়েছে। বিশেষভাবে বর্তমান প্রজন্মের এবং অনাগত বংশধরদের পার্বত্য অঞ্চলের সেই সোনালী দিনগুলোর কথা এবং অতীত ইতিহাসকে জানা একান্ত আবশ্যক।
পার্বত্য অঞ্চলের জৈব্য বৈচিত্র্য, পরিবেশ ধ্বংস ছাড়াও চাকমা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকজনকে বিলুপ্তির কাছাকাছি এনেছে কাপ্তাই বাঁধ। কাপ্তাই বাঁধ পার্বত্যঞ্চলের জনগণের তথা চাকমা জনগোষ্ঠীর দূর্গতির মূল কারণ। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নের নামে নির্মিত এই বাঁধ পার্বত্য অঞ্চলের অন্যতম আদিবাসী জনগোষ্ঠী চাকমা সম্প্রদায়কে বিলুপ্তি ও ধ্বংসের প্রান্তে এনেছে। আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে এই বাঁধ নির্মিত হলেও এর বিরুপ প্রভাব এখনও বিদ্যমান। ভৌগলিক, পরিবেশগত ও জৈব্য বৈচিত্র্যের উপর এর অবর্ণনীয় ক্ষতিকর প্রভাব হাজার বছরব্যাপী অত্রাঞ্চলে বিরাজ করবে। বাঁধ নির্মাণ কার্য যারা প্রত্যক্ষ করেছে কিংবা বাঁধ নির্মাণের ফলে যারা উচ্ছেদ হয়েছে, যারা তাদের পিতৃভূমি জনপদ থেকে স্থানান্তরিত, যারা শারিরীক, মানসিক ও আর্থিকভাবে অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি ও অপরিমেয় দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছে সে সব প্রজন্মের অধিকাংশ লোকজন আচে নেই। আর যারা বেঁচে আছেন তাদের অধিকাংশের বয়স এখন ষাটের উপর থেকে সত্তর-আশির কোঠায়। বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশ লোকজনের যাদের বয়স এখনও পঞ্চাশের নিচে তাদের কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ পূর্বকালীন পার্বত্যঞ্চলের সেই হারিয়ে যাওয়া সোনালী দিনগুলো প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়নি। তাদের অধিকাংশেরই জন্ম নতুন পুনর্বাসন এলাকায়। তারা হয়তো অনেকেই তাদের নিকট আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব যারা বয়সে প্রবীণ তাদের নিকট থেকে তৎকালীন পার্বত্য অঞ্চলের সুদিনের কথা সামান্য শুনে থাকবে। তাই বর্তমান প্রজন্মের সময় হয়েছে অতীতকে জানার ও উপলব্ধি করার। আমাদের সেকালের জনগণের অবস্থা কেমন ছিল, পার্বত্য অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক, ভৌগলিক ও পরিবেশগত অবস্থা পরিবর্তনের কারণসমূহ, আমাদের হারিয়ে যাওয়া অতীত কেমন ছিল, কিভাবে পিতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ ও বাস্তুচ্যুত হলাম এসব কৌতুহল হয়তো অনেকেরই জানার আকাঙ্খা রয়েছে। বিশেষভাবে বর্তমান প্রজন্মের এবং অনাগত বংশধরদের পার্বত্য অঞ্চলের সেই সোনালী দিনগুলোর কথা এবং অতীত ইতিহাসকে জানা একান্ত আবশ্যক।
শরদিন্দু শেখর চাকমা লেখায়
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সত্যিকার দুর্ভোগ আরম্ভ হয় যখন কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হয় এবং বাঁধ নির্মাণের ফলে প্রায় ৩৫০ বর্গমাইল এলাকা — যেটি পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে উর্বর এলাকা ছিল — কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ডুবে যায়। বাঁধটির নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৯৫২ সালে ও শেষ হয় ১৯৫৮ সালের প্রথম দিকে। কিন্তু যখন বাঁধের সব spill way বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন বাঁধটি ভেঙ্গে যায়। তারপর জেনারেল আয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর আমেরিকার সাহায্যে আবার নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৯৬১ সালে শেষ হয়।বাঁধ নির্মাণের সময় বলা হয় যে মাত্র ২৫০ বর্গমাইল এলাকা ডুবে যাবে, কিন্তু বাঁধ নির্মাণ শেষে দেখা গেল যে ৩৫০ বর্গমাইল এলাকা ডুবে গেছে এবং বর্ষাকালে লেকের পানি বেড়ে গেলে কর্ণফুলী হ্রদের আয়তন হয় ৪০০ বর্গমাইল। এই ৩৫০ অথবা ৪০০ বর্গমাইলের মধ্যে অনেকের নিজস্ব ফলের এবং সেগুন বাগান, সরকারের সংরক্ষিত বন এবং সেই সঙ্গে unclassed field state forest ডুবে যায়। বর্তমানে রাঙ্গামাটি শহরের প্রধান বাজার যেটি রিজার্ভ বাজার নামে পরিচিত, সেটা কর্ণফুলী বাঁধ নির্মাণের আগে সংরক্ষিত বন ছিল। সে জন্য বাজারের নাম রিজার্ভ বাজার হয়েছে।
বাঁধ নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ৩৬৯ মৌজার মধ্যে ১২৫ টি মৌজা পানির তলে চলে যায়। এতে ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি অর্থাৎ জেলার মোট কৃষি জমির প্রায় ৪০% হ্রদের জলে ডুবে যায়। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ১ লাখ লোক। যাদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল চাকমা। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট লোক সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লাখ অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ ভাগের ১ ভাগ লোক কর্ণফুলী বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১ লাখ লোকের মধ্যে পরিবারের সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার এবং তাদের মধ্যে ১০ হাজার পরিবার ছিল কৃষি জমির মালিক। বাকীরা ছিল জুম চাষী।
ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য কাসালং সংরক্ষিত বনের এলাকা dereserve করা হয় এবং সেখানে প্রায় ১০ হাজার একর কৃষি জমি পাওয়া যায়। সে জমিতে ৩,৭৩৪ পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়। কিন্তু সর্বোৎকৃষ্ট জমিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালি পরিবারগুলোকে দেয়া হয়। রামগড় এবং বান্দরবান মহকুমায়ও ১১,৩২২ একর সরকারী খাস জমি পাওয়া যায়। কিন্তু আসলে এই সব জমি ছিল চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরা উপজাতিদের আবাদী জমি কিন্তু তাদের বন্দোবস্তকৃত ছিল না। কারণ ইতিপূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে cadastral survey না হওয়াতে লোকজন জমি বন্দোবস্তের জন্য আবেদন করলে জমির প্লট এবং খতিয়ান উল্লেখ করে আবেদন করতে পারতো না। তারা আবেদন করতো জমির চৌহদ্দি উল্লেখ করে এবং জমির পরিমাণ উল্লেখ থাকত অনুমানের উপর ভিত্তি করে। কাজেই সেই জমি আবাদ করার পরে, জরিপ করা হলে জমির পরিমাণ কম বেশি হতো। তাই কাপ্তাই বাঁধের ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য যখন খাস কৃষি জমি খোঁজা হয় তখন সে সব এলাকার লোকজনের জমি জরিপ করে দেখা হয় এবং উল্লেখিত ১১,৩২২ একর কৃষি জমি পাওয়া যায়। ফলে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কারণে কেবল যাদের ঘরবাড়ি ডুবে গেছে, কেবল তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাই নয়, যাদের ঘরবাড়ি জায়গাজমি ডুবে যায়নি তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ তাদের আবাদি কৃষি জমি কিন্তু অবন্দোবস্তকৃত জমি এখন উদ্বাস্তুদের নামে বন্দোবস্ত দেয়া হয়। তবুও কৃষি জমির অভাবে কর্ণফুলী বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত সকলকে পুনর্বাসিত করা সম্ভব হয়নি। যাদের পুনর্বাসন করা যায়নি তাদের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার জুমিয়া পরিবার এবং আরও কয়েক হাজার চাষী পরিবার যাদের পূর্বে কৃষি জমি ছিল, কিন্তু সে জমি হ্রদের পানিতে ডুবে যায়। এভাবে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল অধিবাসীই বেশি আর কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।বাঁধ নির্মাণের ফলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তাদের খুবই নাম মাত্র ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। তাছাড়া জুমিয়া পরিবার এবং অন্যদের যাদের বসতভিটা বন্দোবস্তকৃত ছিল না, অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েল অনুযায়ী যারা খাস জমিতে ঘরবাড়ি অথবা ফলের বাগান করেছিল তাদের বসতভিটা অথবা ফলের বাগানের জমির জন্য ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি। তারা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল কেবল বাড়িঘরের এবং ফলবান বৃক্ষের। জুমিয়ারা প্রত্যেক জুমের জন্য ৬ টাকা খাজনা দিয়ে জুম চাষ করতো। তারা জুমের জন্য কোনও ক্ষতিপূরণ পায়নি।
ক্ষতিপূরণ দেওয়ার হার ছিল নিন্মরুপ:
(ক) প্রথম শ্রেণীর জমি প্রতি একর ৬০০ টাকা
(খ) দ্বিতীয় শ্রেণীর জমি প্রতি একর ৪০০ টাকা
(গ) তৃতীয় শ্রেণীর জমি প্রতি একর ২০০ টাকা
(ঘ) পরিবার পিছু বসতবাড়ির জন্য (গড়ে) ৫০০ টাকা
(ঙ) প্রতি ফলবান বৃক্ষ ১০ টাকা
(চ) প্রতি অফলবান বৃক্ষ ৫ টাকা
(ছ) প্রতি কলাগাছ ০.২৫ পয়সা
(জ) প্রতি আনারস গাছ ০.৬ পয়সা
যদিও ১৯৬১ সালে বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ হয়, ১৯৬৪ সালে যখন আমি রাঙ্গামাটি বদলি হই তখনও অনেকে সেই ক্ষতিপূরণ পায়নি।
১৯৭০ সালে Far Eastern Review ম্যাগাজিনে একটি প্রতিবেদনে বলা হয় যে কর্ণফুলী প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য ৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছিল, মাত্র ২.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করা হয়েছিল।
কাপ্তাই বাঁধের ক্ষতিগ্রস্তদের এভাবে বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (তখন চট্টগ্রাম কলেজে বিএ ক্লাশের ছাত্র) একটি প্রচারপত্রও চট্টগ্রাম শহরসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে বিতরণ করেন। তখন ১৯৬৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে আটক করা হয়। কিন্তু এম এন লারমার বিরুদ্ধে সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। কারণ লারমা যে প্রচারপত্র বিতরণ করেছিলেন সেই প্রচারপত্রে ছিল কাপ্তাই ক্ষতিগ্রস্তদের বঞ্চনার বর্ণনা এবং তাদের যথাযথ পুনর্বাসনের দাবি।
এই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সত্তরের দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশের নবগঠিত শাসনতন্ত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের জন্য কোনও বিশেষ অধিকার লাভে ব্যর্থ হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণআন্দোলন শুরু করেন। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে এবং ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের নতুন শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়। কিন্তু গণপরিষদের সদস্য হিসেবে সেই শাসনতন্ত্রে তিনি স্বাক্ষর করেন নি। কারণ শাসনতন্ত্রে উপজাতিদের কোনও অধিকার স্বীকৃতি পায়নি।
১৯৮৩ সালের ৯ নভেম্বর তারিখে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তারই গঠিত জনসংহতি সমিতির একটি বিদ্রোহী গ্রুপের হাতে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বে আন্দোলন চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তির মাধ্যমে বিরোধের মীমাংসা হয় এবং সেই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহেরও অবসান হয়।এখানে উল্লেখ্য যে, যদিও পার্বত্য জেলার মোট আয়তন ৫,০৯৩ বর্গমাইল অর্থাৎ দেশের আয়তনের দশ ভাগের এক ভাগ, কিন্তু সমগ্র জেলাটি পাহাড় পর্বত, উঁচু-নিচু টিলা নদনদী ঝরনা ইত্যাদিতে ভর্তি। কৃষি জমির পরিমাণ খুবই কম। সম্ভবত সেই কারণেই ১৯০০ সালে যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েল প্রণীত হয় তখন ম্যানুয়েলের একটি ধারায় বলা হয় যে এখন হতে জেলায় কোনও পরিবারকে ২৫ একরের বেশি কৃষি জমি বন্দোবস্ত দেয়া চলবে না। এরপর কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট কৃষি জমির ৪০ ভাগ কর্ণফুলী লেকের নিচে চলে যায়। সর্বোচ্চ সংখ্যক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েলে সংশোধন করে একটি নতুন বিধি যোগ করা হয় যাতে বল হয় যে ভবিষ্যতে কোনও পরিবারকে ১০ একরের বেশি কৃষি জমি বন্দোবস্ত দেয়া যাবে না। বাংলাদেশ হওয়ার পরে সেই ১০ একর কমিয়ে ৫ একর করা হয়।
১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সরকার Forestall Forestry and Engineering International Ltd. নামে এক কানাডিয়ান কোম্পানীকে পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি এবং ভূমির ব্যবহার, উপজাতি সমাজের উপর কাপ্তাই বাঁধের প্রভাব এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের কৃষি উন্নয়নে কি কি ব্যবস্থা নেয়া যায় ইত্যাদি বিষয়ে জরিপ পরিচালনার জন্য নিয়োগ করে। এই জরিপকার্য কলম্বো পরিকল্পনার অধীনে কানাডিয়ান সরকারের আর্থিক সাহায্যে করা হয়। কোম্পানীটি ১৯৬৪ হতে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত দু বছর জরিপ চালিয়ে মোট ৯ খণ্ডে একটি বিরাট প্রতিবেদন পেশ করে।
উল্লেখিত প্রতিবেদনে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিকে মোট চারভাগে ভাগ করা হয় এবং কি আয়তন ভূমিতে কী কী ফসল উৎপাদন করা সম্ভব তা নিন্মোক্তভাবে বর্ণনা করা হয়:
(ক) চাষাবাদ যোগ্য জমি: ৭৭,০০০ একর (মোট জমির ০২%)
(খ) ফলের বাগান করার উপযোগী: ৬,৭০,০০০ একর (মোট জমির ২১%)
(গ) কেবল বন করার উপযোগী: ১৬,০০,০০০ একর (মোট জমির ৫১%)
(ঘ) সংরক্ষিত বন: ৮০০,০০০ একর (মোট জমির ২৬%)
মোট: ৩১,৪৭,০০০ একর
কাজেই দেখা যায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আয়তনে বড় হলেও, সেখানে চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ খুবই কম।
Kalindi Kumar Chakma’s private collection (সংগ্রহঃ সমারী চাকমা, পর্ব ২: একজন ডুবুরীর আত্মকথন, thotkata.net, ২২ জুন ২০১৩ )
কর্ণফুলী বাঁধ নির্মাণের সময় এবং পরবর্তীকালে বাঁধ নির্মাণের ফলে যে সব জায়গা ডুবে যাবে সেই সব জায়গায় জঙ্গল পরিষ্কার করে সেই জঙ্গলের গাছ অপসারণ, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দান, তাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি কাজে তখন হাজার হাজার শ্রমিক, ঠিকাদার, ব্যবসায়ী, কাপ্তাই প্রজেক্ট এবং অন্যান্য সরকারী বেসরকারী কাজেও হাজার হাজার বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। অনেক সুযোগ সন্ধানী বাঙালি সরকারী কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কেবল চাকরী বাকরী, ঠিকাদারী, ব্যবসা নয়, কাপ্তাই প্রকল্পের উদ্বাস্তু হিসেবে পরিচয় দিয়ে ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনও দাবি করে এবং পেয়েও যায়। তখন সুবিধাবাদী, সুযোগ সন্ধানী বাঙালিদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম কেবল উর্বর ক্ষেত্রে নয়, একটি স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। পাহাড়িরা এমনকি বৃটিশ আমলে আগত অনেক বাঙালিও ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন না পেয়ে চরম হতাশ হয়ে পড়ে।এরকম অবস্থায় ১৯৬৪ সালের প্রথম দিকে ভারতের কাশ্মীরের হযরত বাল দরগা হতে মহানবীর কেশ চুরিকে কেন্দ্র করে কলকাতাসহ ভারতের অনেক স্থানে দাঙ্গা লেগে যায়। দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় তদানীন্তন গভর্ণর মোনায়েম খানের মদদে পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা বাঁধে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে এই প্রথম দাঙ্গা বাঁধে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক জায়গায় বিশেষ করে নতুন বসতি এলাকা মারিশ্যায় অন্য জেলা হতে আগত বাঙালিরা পাহাড়িদের উপর চড়াও হয় এবং বহু মেয়ের শ্লীলতাহানি করে। এক দিকে ক্ষতিগ্রস্ত এবং উদ্বাস্তু অপর দিকে তারা পুনর্বাসন তো দূরের কথা জমিজমা এবং ঘরবাড়িরও ক্ষতিপূরণ পায়নি। তারপর তাদের এবং তাদের মেয়েদের অত্যাচার। ফলে তারা ধরেই নেয় যে, পাকিস্তানে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। হাজার হাজার উপজাতি রামগড়, বিশেষ করে নতুন পুনর্বাসিত এলাকা মারিশ্যা হতে ভারতে চলে যাওয়া শুরু করে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে ব্যাপক হারে আদিবাসী জনগণ ভারতে চলে যাওয়া শুরু করলে ভারত সরকার তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন ফোরামে বিষয়টি উত্থাপন করে। সংবাদপত্র এবং অন্যান্য গণমাধ্যমসমূহও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার শুরু করে। তাছাড়া শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দর নায়েকও পাকিস্তানের কাছে কড়া প্রতিবাদ করেন। এতে পাকিস্তান সরকারের টনক নড়ে। গভর্ণর মোনায়েম নিজে রাঙ্গামাটি এবং বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা মারিশ্যায় বার বার পরিদর্শন করতে যান এবং উপজাতিদের যথাযথভাবে পুনর্বাসনের এবং তাড়াতাড়ি ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দেন। সেই সঙ্গে তিনি উপজাতিদের ভারতে না যেতে অনুরোধ করতে থাকেন।
তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সরকারী কর্মকর্তা এতদিন যারা অন্য জেলায় কর্মরত ছিলেন, তাদের প্রায় সকলকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি করে আনা হয়। ঐ সময় আমি রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহকুমায় মাত্র কিছু দিন আগে সিলেট হতে যোগদান করেছি। আমাকে টেলিগ্রামের মাধ্যমে রাঙ্গামাটিতে বদলি করে আনা হয় এবং রাঙ্গামাটিতে যোগদান করার পরই সবচেয়ে উপদ্রুত এলাকা মারিশ্যায় পাঠানো হয়। কয়েক জন দুষ্কৃতিকারীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাদের উস্কানিদাতা আনসারীকে পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েলের ৫১ ধারা অনুযায়ী বহিষ্কার করা হয়। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে এবং উপজাতিদের ভারতে যাওয়াও বন্ধ হয়।
কিন্তু এর মধ্যেও ৪০ হাজারের অধিক আদিবাসী ভারতে চলে যায়। ভারত সরকার তাদের প্রায় সবাইকে বর্তমান অরুণাচল প্রদেশে পুনর্বাসন করে। কিছু কিছু শরণার্থী ত্রিপুরা রাজ্যে এবং কিছু কিছু আসামেও স্ব স্ব উদ্যোগে পুনর্বাসিত হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় যারা অরুণাচল প্রদেশে পুনর্বাসিত হয়েছে তারা এখনও সকলে পুরোপুরিভাবে ভারতীয় নাগরিকত্ব পায়নি। ফলে তারা এখন সেখানে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
বাঁধ নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ৩৬৯ মৌজার মধ্যে ১২৫ টি মৌজা পানির তলে চলে যায়। এতে ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি অর্থাৎ জেলার মোট কৃষি জমির প্রায় ৪০% হ্রদের জলে ডুবে যায়। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ১ লাখ লোক। যাদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল চাকমা। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট লোক সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লাখ অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ ভাগের ১ ভাগ লোক কর্ণফুলী বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১ লাখ লোকের মধ্যে পরিবারের সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার এবং তাদের মধ্যে ১০ হাজার পরিবার ছিল কৃষি জমির মালিক। বাকীরা ছিল জুম চাষী।
ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য কাসালং সংরক্ষিত বনের এলাকা dereserve করা হয় এবং সেখানে প্রায় ১০ হাজার একর কৃষি জমি পাওয়া যায়। সে জমিতে ৩,৭৩৪ পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়। কিন্তু সর্বোৎকৃষ্ট জমিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালি পরিবারগুলোকে দেয়া হয়। রামগড় এবং বান্দরবান মহকুমায়ও ১১,৩২২ একর সরকারী খাস জমি পাওয়া যায়। কিন্তু আসলে এই সব জমি ছিল চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরা উপজাতিদের আবাদী জমি কিন্তু তাদের বন্দোবস্তকৃত ছিল না। কারণ ইতিপূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে cadastral survey না হওয়াতে লোকজন জমি বন্দোবস্তের জন্য আবেদন করলে জমির প্লট এবং খতিয়ান উল্লেখ করে আবেদন করতে পারতো না। তারা আবেদন করতো জমির চৌহদ্দি উল্লেখ করে এবং জমির পরিমাণ উল্লেখ থাকত অনুমানের উপর ভিত্তি করে। কাজেই সেই জমি আবাদ করার পরে, জরিপ করা হলে জমির পরিমাণ কম বেশি হতো। তাই কাপ্তাই বাঁধের ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য যখন খাস কৃষি জমি খোঁজা হয় তখন সে সব এলাকার লোকজনের জমি জরিপ করে দেখা হয় এবং উল্লেখিত ১১,৩২২ একর কৃষি জমি পাওয়া যায়। ফলে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কারণে কেবল যাদের ঘরবাড়ি ডুবে গেছে, কেবল তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাই নয়, যাদের ঘরবাড়ি জায়গাজমি ডুবে যায়নি তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ তাদের আবাদি কৃষি জমি কিন্তু অবন্দোবস্তকৃত জমি এখন উদ্বাস্তুদের নামে বন্দোবস্ত দেয়া হয়। তবুও কৃষি জমির অভাবে কর্ণফুলী বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত সকলকে পুনর্বাসিত করা সম্ভব হয়নি। যাদের পুনর্বাসন করা যায়নি তাদের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার জুমিয়া পরিবার এবং আরও কয়েক হাজার চাষী পরিবার যাদের পূর্বে কৃষি জমি ছিল, কিন্তু সে জমি হ্রদের পানিতে ডুবে যায়। এভাবে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল অধিবাসীই বেশি আর কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।বাঁধ নির্মাণের ফলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তাদের খুবই নাম মাত্র ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। তাছাড়া জুমিয়া পরিবার এবং অন্যদের যাদের বসতভিটা বন্দোবস্তকৃত ছিল না, অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েল অনুযায়ী যারা খাস জমিতে ঘরবাড়ি অথবা ফলের বাগান করেছিল তাদের বসতভিটা অথবা ফলের বাগানের জমির জন্য ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি। তারা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল কেবল বাড়িঘরের এবং ফলবান বৃক্ষের। জুমিয়ারা প্রত্যেক জুমের জন্য ৬ টাকা খাজনা দিয়ে জুম চাষ করতো। তারা জুমের জন্য কোনও ক্ষতিপূরণ পায়নি।
(ক) প্রথম শ্রেণীর জমি প্রতি একর ৬০০ টাকা
(খ) দ্বিতীয় শ্রেণীর জমি প্রতি একর ৪০০ টাকা
(গ) তৃতীয় শ্রেণীর জমি প্রতি একর ২০০ টাকা
(ঘ) পরিবার পিছু বসতবাড়ির জন্য (গড়ে) ৫০০ টাকা
(ঙ) প্রতি ফলবান বৃক্ষ ১০ টাকা
(চ) প্রতি অফলবান বৃক্ষ ৫ টাকা
(ছ) প্রতি কলাগাছ ০.২৫ পয়সা
(জ) প্রতি আনারস গাছ ০.৬ পয়সা
যদিও ১৯৬১ সালে বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ হয়, ১৯৬৪ সালে যখন আমি রাঙ্গামাটি বদলি হই তখনও অনেকে সেই ক্ষতিপূরণ পায়নি।
১৯৭০ সালে Far Eastern Review ম্যাগাজিনে একটি প্রতিবেদনে বলা হয় যে কর্ণফুলী প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য ৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছিল, মাত্র ২.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করা হয়েছিল।
কাপ্তাই বাঁধের ক্ষতিগ্রস্তদের এভাবে বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (তখন চট্টগ্রাম কলেজে বিএ ক্লাশের ছাত্র) একটি প্রচারপত্রও চট্টগ্রাম শহরসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে বিতরণ করেন। তখন ১৯৬৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে আটক করা হয়। কিন্তু এম এন লারমার বিরুদ্ধে সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। কারণ লারমা যে প্রচারপত্র বিতরণ করেছিলেন সেই প্রচারপত্রে ছিল কাপ্তাই ক্ষতিগ্রস্তদের বঞ্চনার বর্ণনা এবং তাদের যথাযথ পুনর্বাসনের দাবি।
এই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সত্তরের দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশের নবগঠিত শাসনতন্ত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের জন্য কোনও বিশেষ অধিকার লাভে ব্যর্থ হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণআন্দোলন শুরু করেন। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে এবং ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের নতুন শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়। কিন্তু গণপরিষদের সদস্য হিসেবে সেই শাসনতন্ত্রে তিনি স্বাক্ষর করেন নি। কারণ শাসনতন্ত্রে উপজাতিদের কোনও অধিকার স্বীকৃতি পায়নি।
১৯৮৩ সালের ৯ নভেম্বর তারিখে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তারই গঠিত জনসংহতি সমিতির একটি বিদ্রোহী গ্রুপের হাতে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বে আন্দোলন চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তির মাধ্যমে বিরোধের মীমাংসা হয় এবং সেই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহেরও অবসান হয়।এখানে উল্লেখ্য যে, যদিও পার্বত্য জেলার মোট আয়তন ৫,০৯৩ বর্গমাইল অর্থাৎ দেশের আয়তনের দশ ভাগের এক ভাগ, কিন্তু সমগ্র জেলাটি পাহাড় পর্বত, উঁচু-নিচু টিলা নদনদী ঝরনা ইত্যাদিতে ভর্তি। কৃষি জমির পরিমাণ খুবই কম। সম্ভবত সেই কারণেই ১৯০০ সালে যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েল প্রণীত হয় তখন ম্যানুয়েলের একটি ধারায় বলা হয় যে এখন হতে জেলায় কোনও পরিবারকে ২৫ একরের বেশি কৃষি জমি বন্দোবস্ত দেয়া চলবে না। এরপর কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট কৃষি জমির ৪০ ভাগ কর্ণফুলী লেকের নিচে চলে যায়। সর্বোচ্চ সংখ্যক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েলে সংশোধন করে একটি নতুন বিধি যোগ করা হয় যাতে বল হয় যে ভবিষ্যতে কোনও পরিবারকে ১০ একরের বেশি কৃষি জমি বন্দোবস্ত দেয়া যাবে না। বাংলাদেশ হওয়ার পরে সেই ১০ একর কমিয়ে ৫ একর করা হয়।
১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সরকার Forestall Forestry and Engineering International Ltd. নামে এক কানাডিয়ান কোম্পানীকে পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি এবং ভূমির ব্যবহার, উপজাতি সমাজের উপর কাপ্তাই বাঁধের প্রভাব এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের কৃষি উন্নয়নে কি কি ব্যবস্থা নেয়া যায় ইত্যাদি বিষয়ে জরিপ পরিচালনার জন্য নিয়োগ করে। এই জরিপকার্য কলম্বো পরিকল্পনার অধীনে কানাডিয়ান সরকারের আর্থিক সাহায্যে করা হয়। কোম্পানীটি ১৯৬৪ হতে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত দু বছর জরিপ চালিয়ে মোট ৯ খণ্ডে একটি বিরাট প্রতিবেদন পেশ করে।
উল্লেখিত প্রতিবেদনে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিকে মোট চারভাগে ভাগ করা হয় এবং কি আয়তন ভূমিতে কী কী ফসল উৎপাদন করা সম্ভব তা নিন্মোক্তভাবে বর্ণনা করা হয়:
(ক) চাষাবাদ যোগ্য জমি: ৭৭,০০০ একর (মোট জমির ০২%)
(খ) ফলের বাগান করার উপযোগী: ৬,৭০,০০০ একর (মোট জমির ২১%)
(গ) কেবল বন করার উপযোগী: ১৬,০০,০০০ একর (মোট জমির ৫১%)
(ঘ) সংরক্ষিত বন: ৮০০,০০০ একর (মোট জমির ২৬%)
মোট: ৩১,৪৭,০০০ একর
কাজেই দেখা যায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আয়তনে বড় হলেও, সেখানে চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ খুবই কম।
Kalindi Kumar Chakma’s private collection (সংগ্রহঃ সমারী চাকমা, পর্ব ২: একজন ডুবুরীর আত্মকথন, thotkata.net, ২২ জুন ২০১৩ )
কর্ণফুলী বাঁধ নির্মাণের সময় এবং পরবর্তীকালে বাঁধ নির্মাণের ফলে যে সব জায়গা ডুবে যাবে সেই সব জায়গায় জঙ্গল পরিষ্কার করে সেই জঙ্গলের গাছ অপসারণ, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দান, তাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি কাজে তখন হাজার হাজার শ্রমিক, ঠিকাদার, ব্যবসায়ী, কাপ্তাই প্রজেক্ট এবং অন্যান্য সরকারী বেসরকারী কাজেও হাজার হাজার বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। অনেক সুযোগ সন্ধানী বাঙালি সরকারী কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কেবল চাকরী বাকরী, ঠিকাদারী, ব্যবসা নয়, কাপ্তাই প্রকল্পের উদ্বাস্তু হিসেবে পরিচয় দিয়ে ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনও দাবি করে এবং পেয়েও যায়। তখন সুবিধাবাদী, সুযোগ সন্ধানী বাঙালিদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম কেবল উর্বর ক্ষেত্রে নয়, একটি স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। পাহাড়িরা এমনকি বৃটিশ আমলে আগত অনেক বাঙালিও ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন না পেয়ে চরম হতাশ হয়ে পড়ে।এরকম অবস্থায় ১৯৬৪ সালের প্রথম দিকে ভারতের কাশ্মীরের হযরত বাল দরগা হতে মহানবীর কেশ চুরিকে কেন্দ্র করে কলকাতাসহ ভারতের অনেক স্থানে দাঙ্গা লেগে যায়। দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় তদানীন্তন গভর্ণর মোনায়েম খানের মদদে পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা বাঁধে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে এই প্রথম দাঙ্গা বাঁধে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক জায়গায় বিশেষ করে নতুন বসতি এলাকা মারিশ্যায় অন্য জেলা হতে আগত বাঙালিরা পাহাড়িদের উপর চড়াও হয় এবং বহু মেয়ের শ্লীলতাহানি করে। এক দিকে ক্ষতিগ্রস্ত এবং উদ্বাস্তু অপর দিকে তারা পুনর্বাসন তো দূরের কথা জমিজমা এবং ঘরবাড়িরও ক্ষতিপূরণ পায়নি। তারপর তাদের এবং তাদের মেয়েদের অত্যাচার। ফলে তারা ধরেই নেয় যে, পাকিস্তানে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। হাজার হাজার উপজাতি রামগড়, বিশেষ করে নতুন পুনর্বাসিত এলাকা মারিশ্যা হতে ভারতে চলে যাওয়া শুরু করে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে ব্যাপক হারে আদিবাসী জনগণ ভারতে চলে যাওয়া শুরু করলে ভারত সরকার তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন ফোরামে বিষয়টি উত্থাপন করে। সংবাদপত্র এবং অন্যান্য গণমাধ্যমসমূহও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার শুরু করে। তাছাড়া শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দর নায়েকও পাকিস্তানের কাছে কড়া প্রতিবাদ করেন। এতে পাকিস্তান সরকারের টনক নড়ে। গভর্ণর মোনায়েম নিজে রাঙ্গামাটি এবং বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা মারিশ্যায় বার বার পরিদর্শন করতে যান এবং উপজাতিদের যথাযথভাবে পুনর্বাসনের এবং তাড়াতাড়ি ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দেন। সেই সঙ্গে তিনি উপজাতিদের ভারতে না যেতে অনুরোধ করতে থাকেন।
তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সরকারী কর্মকর্তা এতদিন যারা অন্য জেলায় কর্মরত ছিলেন, তাদের প্রায় সকলকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি করে আনা হয়। ঐ সময় আমি রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহকুমায় মাত্র কিছু দিন আগে সিলেট হতে যোগদান করেছি। আমাকে টেলিগ্রামের মাধ্যমে রাঙ্গামাটিতে বদলি করে আনা হয় এবং রাঙ্গামাটিতে যোগদান করার পরই সবচেয়ে উপদ্রুত এলাকা মারিশ্যায় পাঠানো হয়। কয়েক জন দুষ্কৃতিকারীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাদের উস্কানিদাতা আনসারীকে পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েলের ৫১ ধারা অনুযায়ী বহিষ্কার করা হয়। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে এবং উপজাতিদের ভারতে যাওয়াও বন্ধ হয়।
কিন্তু এর মধ্যেও ৪০ হাজারের অধিক আদিবাসী ভারতে চলে যায়। ভারত সরকার তাদের প্রায় সবাইকে বর্তমান অরুণাচল প্রদেশে পুনর্বাসন করে। কিছু কিছু শরণার্থী ত্রিপুরা রাজ্যে এবং কিছু কিছু আসামেও স্ব স্ব উদ্যোগে পুনর্বাসিত হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় যারা অরুণাচল প্রদেশে পুনর্বাসিত হয়েছে তারা এখনও সকলে পুরোপুরিভাবে ভারতীয় নাগরিকত্ব পায়নি। ফলে তারা এখন সেখানে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন