সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও ইতিহাস

নিঝুম তালুকদার আদিবাসী প্রসঙ্গ বস্তুতঃ বাংলাদেশে ‘ইন্ডিজেনাস’ বা ‘আদিবাসী’ কারা তা একটি মীমাংসিত বিষয়। কিন্তু তারপরও সরকার ও বাঙালী জাত্যাভিমানী-সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন একটি গোষ্ঠী জেনেও না জানার ভান করে আদিবাসী নিয়ে বিতর্কের অবতাড়না করছে। বিষয়টিকে জটিল রূপ দিয়েছে। ‘আদিবাসী’ বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল বা বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে সরকার আদিবাসীদের ন্যায্য অধিকারকে অস্বীকার করতে চাইছে অথবা তার দায়দায়িত্ব থেকে সরে যেতে চাইছে। অন্য কোন দেশে এমন হয়নি। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ এবং গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তি বলে দাবীদার আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছে। আবার বলা যেতে পারে, সরকার বর্তমানে আদিবাসী বিষয়ে ও আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে বা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। অথবা আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে সরকার যে চরম রক্ষণশীল, এমনকী প্রতিক্রিয়াশীল- তার মুখোশই উন্মোচিত হয়েছে। এ জন্য এই সরকারকে একদিন মাশুল দিতে হবে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের আদিবাসীরা হুট করে নিজেরাই নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ বলে দাবী করে বসেনি। জাতিসংঘ

বৃটিশ শাসনে চাকমা জনগোষ্ঠীর সম্পাদনা

নিঝুম তালুকদার


পলাশীর যুদ্ধের তিন বছর পরে, মুর্শিদাবাদের নতুন নবাব মীর কাশিম বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে চট্টগ্রাম বর্ধমান এবং মেদিনীপুর উপহার হিসেবে দিয়ে দেন। যেটি গতকাল আলোচনায় বলা হয়েছে। দিনটি ছিল ৫ জানুয়ারী ১৭৬১ সালে, কোম্পানীর প্রতিনিধি হ্যারি ভেরেলস্ট চট্টগ্রামের শাসনভার সুবেদার মোহাম্মদ রেজা খানের কাছ থেকে গ্রহন করেন। তবে তখনো চাকমা রাজা শের দৌলত খান স্বাধীনভাবে তার রাজ্য পরিচালনা এবং মুঘলদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। এবং কোম্পানীর শাসন মেনে না নিয়ে কোম্পানী কর্তৃক ধার্য নির্ধারিত খাজনা প্রদানে বিরত ছিলেন।
ফলে কোম্পানির সাথে একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের সূত্রপাত হয়, যা ১৭৮৭ সালপর্যন্ত চলেছিল। কোম্পানী চাকমা রাজের বিরুদ্ধে চারটি যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। সেগুলো হল - ১৭৭০, ১৭৮০, ১৭৮২ এবং ১৭৮৫ সালের যুদ্ধ। যুদ্ধে কোম্পানী বিশেষ সুবিধে করতে না পারায় এবং চাকমা রাজ্যে বাণিজ্য অবরোধের ফলে সৃষ্ট সমস্যায় - দুই পক্ষই ১৭৮৫ সালে একটি শান্তি আলোচনা চালায়। চাকমা রাজের পক্ষে রাজা জানবক্স খান, শের দৌলত খানের পুত্র অংশ নেন। পরবর্তীতে ১৭৮৭ সালে কলকাতায় চাকমা রাজের সাথে কোম্পানীর একটি শান্তি চুক্তি সম্পন্ন হয়। চুক্তি অনুযায়ী চাকমা রাজা কোম্পানীর আধিপত্য মেনে নেওয়ার পাশাপাশি বছরে ৫০০ মণ তুলা দেওয়ার প্রতিশ্রতি দেন, বিনিময়ে কোম্পানী চাকমা রাজার আঞ্চলিক আধিপত্য মেনে নিয়ে বাণিজ্য অবরোধ তুলে নেয়। জানবক্স খান তার রাজ্যের রাজধানী রাজানগরে সরিয়ে নেন, যা বর্তমান রাংনীয়ার রানীরহাটে অবস্থিত। ১৮০০ সালে জানবক্স খানের মৃত্যুর পর তার পুত্র তব্বর খান রাজা হন, কিন্তু কিছু সময়ের ব্যবধানে তিনিও মারা গেলে, তার ছোট ভাই জব্বর খান রাজা হন। জব্বর খান ১০ বছর পর্যন্ত শাসন করেন। তার মৃত্যুর পর তারই সন্তান ধরম বক্স খান ১৮১২ সালে রাজা হন। ধরম বক্স খান ১৮৩২ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ১৮৩২ সালে তার মৃত্যুর পর পুরুষ উত্তরাধিকারের অভাবে রাজ্য শাসনে অরাজকতা দেখা দেয়। ফলে কোম্পানীর হস্তক্ষেপে সুখলাল দেওয়ান কে অন্তর্বতীকালীন ম্যানেজার নিয়োগ দেয়া হয়। এই সময়কালে ধরম বক্স খানের বিধবা স্ত্রী রানী কালিন্দী কোম্পানীর কাছে রাজ্য পরিচালন ভার দেওয়ার আবেদন করেন। কোম্পানীর সরকার রানীর আবেদন গ্রহন করে ১৮৪৪ সালে একটি আদেশ জারি করে। 
১৮৬৪ সালে নতুন খাজনা ধার্য করা হয়, যার পরিমান দাঁড়ায় বছরে ১১,৮০৩ টাকা।

সিপাহী বিদ্রোহের পরে ১৮৫৭ সালে বৃটিশ সরকার কোম্পানীর কাছ থেকে ভারত শাসন ভার নিয়ে নেয়, এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনভার ও অন্তর্গত ছিল, যা তখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ভাবে চট্টগ্রাম থেকে আলাদা করা হয় নি। তবে, বৃটিশ সরকার নতুন দায়িত্বভার গ্রহন করার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমানা নির্দেশ করে একটি প্রত্যাদেশ বাংলা ৬ শ্রাবন ১১৭০ সনে জারি করেন। প্রত্যাদেশ অনুযায়ী ফেনী নদী হতে শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী সকল পাহাড় এবং চট্টগ্রামের নিজামপুর রোড হতে কুকি হিলস পর্যন্ত অঞ্চল কে চাকমা রাজের সীমানাভুক্ত করা হয়। ১৮৭৩ সালে রানী কালিন্দীর মৃত্যুর পর, তার প্রপৌত্র হরিশ চন্দ্র কারবারি চাকমা রাজা হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন এবং রায় বাহাদুর উপাধী প্রদান করা হয়। ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে চাকমা সামরিক বাহিনী ক্রমে দুর্বল হয়ে পরে। কুকি জনগোষ্ঠী, যারা আরো উত্তরের অঞ্চলে স্বাধীন ভাবে বসবাস করত, তারা ১৮৪৭,১৮৪৮, ১৮৫৯ ও ১৮৬০ সালের দিকে ত্রিপুরা, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও রানী কালিন্দী শাসিত চাকমা অঞ্চলে একাধিকার আক্রমন চালায়। এর ফলশ্রুতিতে, আক্রান্ত এলাকা রক্ষা এবং চাকমা ভূখন্ড দখলে নেয়ার মানসিকতা থেকে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর, হিল ট্রাক্ট রেগুলেশন থেকে চাকমা শাসিত অংশটির অপসারন এবং একজন সুপারিন্টেনডেন্ট নিয়োগের সুপারিশ করেন। এই সুপারিশগুলো ১৮৬০ সালের ২২ নং আইনে পাশ করানো হয়, এবং তা একই বছরের ১৮ অগাস্ট থেকে আইন হিসেবে প্রয়োগ করা হয়।
রানী কালিন্দী শাসিত চাকমা অঞ্চল কে প্রশাসনিক ভাবে চট্টগ্রাম থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। এবং এই অঞ্চলের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে একজন সুপারিন্টেনডেন্ট নিয়োগ করা হয় যার সদর দপ্তর ছিল বর্তমান রাঙামাটি জেলার চন্দ্রঘোনায়। এই সুপারিন্টেনডেন্ট এর অধিভুক্ত এলাকাকে, তখন থেকেই প্রথম বারের মত চিটাগাং হিল ট্র‍্যাক্টস হিসেবে নির্দেশ করা হয়। সুপারিন্টেনডেন্ট নিয়োগের পরবর্তী কয়েক বছর শান্তি শৃংখলা বজায় রাখাটাই হয়ে দাড়ায় মূল কাজ।

১৮৬৯ সালে সুপারিন্টেনডেন্ট এর সদর দপ্তর চন্দ্রঘোনা থেকে রাঙামাটিতে স্থানান্তর করা হয়। স্থানান্তর করার আগেই সুপারিন্টেনডেন্ট পদটিকে ডেপুটি কমিশনারে রুপ দেয়া হয়। এবং তাকে এই অঞ্চলের রাজস্ব আদায় থেকে স্থানীয় শাসন ও বিচার ব্যবস্থার সর্বময় ক্ষমতা প্রধান করা হয়। পার্শ্ববর্তী জনগোষ্ঠী গুলোর ক্রমাগত আক্রমন এবং বৃটিশ কর্মকর্তাদের চাপের মুখে চাকমাদের রাজধানী ১৮৭৪ সালে রাজানগর থেকে রাঙামাটি তে স্থানান্তরিত হয়। সেই সময় গুলোয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর পরিমানে তুলা উৎপাদিত হত, যা বৃটিশদের কাছে তাদের দেশের সুতার কলকারখানার কাঁচামাল বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ নিয়ন্ত্রন অত্যন্ত গুরুত্ববহন করতো। ১৮৮১ সালের দিকে বৃটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম কে তিনটি সার্কেলে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। এবং এই সার্কেলের নামমাত্র শাসকদের "সার্কেল চীফ" হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই সার্কেল গুলো হল - চাকমা সার্কেল, বোমাং সার্কেল এবং মং সার্কেল। চাকমা সার্কেল চাকমাদের নিয়ে, আরাকানী বংশোদ্ভূত বোমাং প্রধানের দায়িত্বে বোমাং সার্কেল এবং আরাকানী ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ও ত্রিপুরা অঞ্চলের অভিবাসীদের নিয়ে গঠিত হয় মং সার্কেল।
 আগরতলা ত্রিপুরা রাজবাড়ী 
পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভাগ করার পিছনে মূল কারণ ছিল এই যে, বৃটিশ সরকার, এই অঞ্চলের অন্যান্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠী দের কাছে চাকমা রাজার গ্রহণযোগ্যতাকে ভালো ভাবে নিতে পারছিলো না। উপরন্তু, বৃটিশ সরকার, এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠায় ক্রমানয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিলো। যার ফলে, বৃটিশ সরকার এই অঞ্চলে পূর্ণ নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠায় একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থার ভিত্তি আরোপ করে। যার অন্যতম উদ্দেশ্য গুলো ছিল -

♦ চাকমা রাজের শাসন ক্ষমতার তদারকী এবং কতিপয় ক্ষমতার কাটছাঁট করা।

♦ কুকী আক্রমনের হাত থেকে বৃটিশ কর্মকর্তা এবং বৃটিশ সম্পদ রক্ষা করা।

♦ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শান্ত অবস্থা বজায় রাখা যাতে, এই অঞ্চলে তুলার উৎপাদন আরো বৃদ্ধি করানো যায়।
তিনটি আলাদা সার্কেল গঠন করার পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকী আক্রমন চলতে থাকে। এর মধ্যেই শেন্দু জনগোষ্ঠী ১৮৬৫ থেকে ১৮৮৮ সালের মাঝে পার্বত্য চট্টগ্রামে আক্রমন শানাতে থাকে। এর মধ্যে ১৮৭২ সালে লেফটেন্যান্ট স্টুয়ার্ড ও তার জরিপ দলের উপর হামলা অন্যতম। এই ক্রমাগত হামলার মুখে, ১৮৯০ সালে বাংলা ও আসাম এর বৃটিশ প্রশাসনের সহায়তায় লুসাই পাহাড় থেকে চট্টগ্রাম ও বার্মা পর্যন্ত সেনা অভিযান চালানো হয়। ফলশ্রুতিতে, স্বাধীন কুকীদের আবাস ভুমি বৃটিশ শাসনের অধীনে চলে আসে।
১ এপ্রিল ১৯০০ সালে, দক্ষিণ ও উত্তর লুসাই পাহাড় যা আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের অংশ ছিল, তা আসাম প্রদেশের সাথে সংযুক্ত করা হয়।বর্তমানে লুসাই হিল ভারতের মিজোরাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভাঙন নিশ্চিত ও চাকমা আধিপত্য খর্ব করার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ প্রনয়নের মাধ্যমে, বৃটিশদের পক্ষে ডেপুটি কমিশনার এই চাকমা শাসিত অঞ্চলের পরিপূর্ন শাসন ক্ষমতা গ্রহন করেন। পরবর্তীতে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে পার্বত্য চট্টগ্রাম কে ভারতে বৃটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত না দেখিয়ে, স্বতন্ত্র এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

জুম্মবি আলোচনায সাথে খাকুন। ধন্যবাদ সবাইকে।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চাকমাদের খাঁ, রায়, খীসা, দেওয়ান ও তালুকদার উপাধি

নিঝুম তালুকদার আমি পুর্বের আলোচনাতে চাকমা রাজ বংশের বংশানুক্রমিক ও পিরি নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আর নতুন করে সে বিষয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন নেই। তাই সংক্ষেপে আলোচনা শুরু করছি। সবাই সাথে থাকুন। পড়তে থাকুন। জনু রাজার পুত্র ছিল না―শুধু দুই কন্যা। জনু রাজা ১২০ বৎসর পৰ্যন্ত জীবিত ছিলেন। বড় কন্যা সাজোম্বীকে মগ রাজা বিবাহ করে। দ্বিতীয় কন্যা রাজেস্বীকে বুড়া বড়ুয়া বিবাহ করেন। বুড়া বড়ুয়ার পুত্র সাত্তুয়া রাজা হন। তিনি পরে পাগলা রাজা বলে প্ৰসিদ্ধ হন। পাগলা রাজা অতিশয় জ্ঞানী ছিলেন। কথিত আছে মন্ত্র বলে তিনি চিৎকলিজা বের করে ধৌত করে আবার ঢুকিয়ে রাখতেন। এই কার্য করতে তাঁর রাণী উকি দিয়ে দেখলে, তিনি আর ঢুকাতে পারলেন না। তাঁতে প্রকৃত পাগল হন। যাকে তাকে কাটতে লাগলেন। সেজন্য তার রাণীর সম্মতিতে তাকে হত্যা করা হয়।  প্ৰবাদ আছে- "তিনি একদিন টংগীতে বসেছিলেন এবং জংগলী হাতী এসেছে বলে পূর্ব প্ৰস্তাব মতে মিথ্যা রটনা করাতে বন্য হাতী দেখবার জন্য মাথা বের করলেন। তখন পেছনদিক হতে তার শিরচ্ছেদ করা হয়।" পাগলা রাজার মৃত্যুর পর রাণী রাজকাৰ্য চালান। “কাটুয়া কন্যার” আমল বলে তার দুর্না

কাপ্তাই বাঁধ ও রড়পোরং

নিঝুম তালুকদার কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ পার্বত্যঞ্চলের এক বেদনাদায়ক যুগান্তকারী ঘটনা। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে এই বাঁধ নির্মাণ এই অঞ্চলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়। বিষয়টি এখনও বির্তকিত রয়েছে। পৃথিবীর অনেক আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে উন্নয়নের নামে যে সব প্রকল্প ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বির্পযয় ও বিলুপ্তির জন্য দায়ী কাপ্তাই বাঁধ তন্মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এই বাঁধ অত্রাঞ্চলে পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক বিপর্যয়।  পার্বত্য অঞ্চলের জৈব্য বৈচিত্র্য, পরিবেশ ধ্বংস ছাড়াও চাকমা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকজনকে বিলুপ্তির কাছাকাছি এনেছে কাপ্তাই বাঁধ। কাপ্তাই বাঁধ পার্বত্যঞ্চলের জনগণের তথা চাকমা জনগোষ্ঠীর দূর্গতির মূল কারণ। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নের নামে নির্মিত এই বাঁধ পার্বত্য অঞ্চলের অন্যতম আদিবাসী জনগোষ্ঠী চাকমা সম্প্রদায়কে বিলুপ্তি ও ধ্বংসের প্রান্তে এনেছে। আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে এই বাঁধ নির্মিত হলেও এর বিরুপ প্রভাব এখনও বিদ্যমান। ভৌগলিক, পরিবেশগত ও জৈব্য বৈচিত্র্যের উপর এর অবর্ণনীয় ক্ষতিকর প্রভাব হাজার বছরব্যাপী অত্রাঞ্চলে বিরাজ করবে। বাঁধ নির্মাণ কার্য যারা প্রত্যক্ষ

চাকমা জাতির এক মহীয়সী নারী চাকমা রাণী কালিন্দী

 ইলিরা দেওয়ান চাকমা রানী কালিন্দী কে নিয়ে সকলের মুখে প্রায়ই শোনা যায় যে চাকমা রাণী কালিন্দীর কারনে চাকমা জাতি রাজ্যহারা। তারই ভুলের জলন্ত আগুনের মশালে দহনীয় সমগ্র চাকমা জাতি। রাণী কালিন্দীর বিরদ্ধে সবার মাঝে যে ধারনা সেই বিষয় নিয়ে আজকের সংক্ষিপ্ত আলোচনা । সবাই সাথে থাকুন। পড়তে থাকুন।  বৃটিশ আমলে উপমহাদেশের মহীয়সী নারীদের বীরত্ব গাঁথা কিংবা সমাজে তাঁদের অবদানের কথা বললে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে নবাব ফয়জুন্নেসা, বেগম রোকেয়াদের কথা। কিন্তু তাঁদের জন্মেরও পূর্বে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আরেক মহীয়সী নারীর কথা ক’জনইবা জানেন! উনিশ শতকের প্রথমদিকে রাস্তাঘাটহীন দূর্গম পার্বত্য এলাকার কুদুকছড়ির সাধারণ এক চাকমা জুমিয়া পরিবারে জন্মেছিলেন কালাবি চাকমা। পরবর্তীতে চাকমা রাজা ধরম বক্স খাঁ এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তিনি ‘কালিন্দী রাণী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠলেও তিনি স্বশিতি ছিলেন এবং তাঁর প্রাজ্ঞ দিয়ে রাজপরিবারের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে সম হয়েছিলেন। কালিন্দী রাণী শুধু বৈষয়িক বুদ্ধিতে কিংবা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দূরদর্শিতায় প্রাজ্ঞ ছিলেন না, এর পা

চাকমা রাজবংশের ইতিহাস (২য় পর্ব)

নিঝুম তালুকদার যা গতকালকের আলোচনায় আজুর সত্যি ঘটনার গল্পের কাহিনীতে "চাকোমাস" নামে যে চাকমাদের রাজ্যের নামটি উল্লেখ করা হয়েছিল সেটির ইতিহাস সুত্র ধরে আজুর সত্য ঘটনার গল্পের কাহিনীর সাথে অনেকের ইতিহাস লেখকের লেখা কাহিনীর সাথে মিল পেয়েছি। কারণ বহু লেখক লিখেছেন চাকমাদের রাজ্যের নাম "চাকোমাস"। এবং কিছু কিছু ঘটনাবলীও অনেক মিল রয়েছে। আরো একটি কাহিনী মিলিয়ে দেখুন।  চাকমা রাজপরিবার লিখেছেন-- সুশীল প্রসাদ চাকমা , রাঙ্গামাটি তিনি যা যা লিখেছেন সেগুলোর কপি দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসের সূত্র মতে, হিমালয়ের পাদদেশে শাক্য নামে এক রাজা বাস করতেন। তার রাজধানী ছিল কালপ্পানগর। সেখানে ঈশ্বরের মূর্তি তৈরি করে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন তিনি। যানকুনী মন্ত্রীর জন্ম ওই পরিবারে। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে রাজ্য চালানোর জন্য তার খ্যাতি ছিল ব্যাপক। সুধন্য নামে শাক্য রাজার ছিলেন এক সাহসী ছেলে। তিনি ক্ষত্রীয় বীরদের মতো শত্রুদের দমন করতেন। রাজা সুধন্যর দুই রাণী ও তিন পুত্র সন্তান ছিল। প্রথম রাণীর ছেলে গুণধর রাজকীয় আনন্দ ত্যাগ করে মোহমুক্তির উদ্দেশ্যে সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করেন। কনিষ্ঠ রাণীর আনন্

চাকমা রাজবংশের ইতিহাস

নিঝুম তালুকদার আমরা তখন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরনার্থী অবস্থায় ছিলাম। সেখানে অনেক ছেলে- মেয়েকে আমার আজু প্রায়ই গল্প শুনাতেন। একদিন আজু আজকের আলোচনা বিষয়টি সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক সত্য ঘটনার গল্প বলেছিলেন। আজু যে ভাবে বলেছিলেন ঠিক সেইভাবে ঐ ঘটনার কথা নিয়ে আজকে আলোচনা করতে যাচ্ছি। সবাই সাথে থাকুন। চাকমা রাজপরিবার ইতিহাস অনুসারে সময়টা আনুমানিক ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগ। চম্পক নগরের রাজা সাংবুদ্ধ। সাংবুদ্ধর দুই ছেলে- বড় ছেলের নাম বিজয়গিরি এবং ছোট ছেলের নাম সমরগিরি। যুবরাজ বিজয়গিরি যুদ্ধবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। ছেলেবেলা হতেই তিনি রাজ্য জয় ও রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখতেন। চম্পক নগরের ভাবি রাজা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন।  ত্রিপুরার দক্ষিনে অবস্থিত মগ রাজ্য। মগরা ছিল দুস্য প্রকৃতির। তারা শহর ও গ্রামে লুন্ঠণ এবং মানুষের ওপর অত্যাচার করে বেড়াত । ত্রিপুরা রাজের অধিভূক্ত দক্ষিনাঞ্চলেও তাদের দৌরাত্ম্য থেকে মুক্ত ছিল না । এসময় ত্রিপুরা রাজ্যে অন্তঃবিপ্লবের সম্ভাবনা থাকায় রাজা মগদের দমনে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেনি। যুবরাজ বিজয়গিরি তার সামরিক অভিযানের

চাকমা রাজবংশের বিজক ও পিরি

নিঝুম তালুকদার ৫১তম চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের রাজপিরি ও বিজোগ বিগত কয়েক দিন আগে আমার আলোচনা পোষ্টে "চাকমা রাজবংশের ইতিহাস"টি নিয়ে বিভিন্ন মহলের আরো চাকমা রাজবংশের ইতিহাস সর্ম্পকে জানার আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। তাতে আমারও উৎসাহ অগ্রসর হয়। আমিও উৎসাহ নিয়ে বিজোক ইতিহাস ঘাটাঘাটি করি। ইতিহাস সুত্রমতে বর্তমান চাকমা সার্কেলের রাজা দেবাশীষ রায়ের আমলে তিনি ৫১তম চাকমা রাজা যেভাবে হলেন তা নিয়ে আলোচনা শুরু করি। ০১. অতি পুর্বকালে হিমালয়ের পাদদেশে শাক্য নামে এক রাজা ছিলেন। কলাপ্যা নগর তার রাজ্যের রাজধানী ছিল। তিনি ঐ নগরে ঈশ্বরের এক মূর্তি প্ৰস্তুত করিয়ে পূজা করতেন। ঐ রাজার বংশজ মন্ত্রীর নাম সাংকুস্য। মন্ত্রীরাজ রাজধানী শাসনের ভার নিয়ে দুষ্ট দমন করে সাবধানে প্রজা পালন করতেন। ০২. শাক্যরাজার পুত্ৰ সুধন্য মহা তেজস্বী হয়ে সর্বদা ক্ষত্ৰিয়ভাবে রিপু দমন করে বীর ভাব প্রকাশ করে থাকতেন। সাংকুস্য মন্ত্রীর পুত্ৰ জয়ধন সেনাপতির সংগে মহারাজ সুধন্য যুদ্ধসজ্জায় সর্বদা সজ্জিত থাকতেন এবং শত্রু দমনে সাবধান থাকতেন। সুধন্য মহারাজের দুই রাণী, তিন পুত্র ছিল। বড়রাণীর গর্ভজাত গুণধন রাজভো

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও ইতিহাস

নিঝুম তালুকদার আদিবাসী প্রসঙ্গ বস্তুতঃ বাংলাদেশে ‘ইন্ডিজেনাস’ বা ‘আদিবাসী’ কারা তা একটি মীমাংসিত বিষয়। কিন্তু তারপরও সরকার ও বাঙালী জাত্যাভিমানী-সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন একটি গোষ্ঠী জেনেও না জানার ভান করে আদিবাসী নিয়ে বিতর্কের অবতাড়না করছে। বিষয়টিকে জটিল রূপ দিয়েছে। ‘আদিবাসী’ বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল বা বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে সরকার আদিবাসীদের ন্যায্য অধিকারকে অস্বীকার করতে চাইছে অথবা তার দায়দায়িত্ব থেকে সরে যেতে চাইছে। অন্য কোন দেশে এমন হয়নি। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ এবং গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তি বলে দাবীদার আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছে। আবার বলা যেতে পারে, সরকার বর্তমানে আদিবাসী বিষয়ে ও আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে বা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। অথবা আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে সরকার যে চরম রক্ষণশীল, এমনকী প্রতিক্রিয়াশীল- তার মুখোশই উন্মোচিত হয়েছে। এ জন্য এই সরকারকে একদিন মাশুল দিতে হবে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের আদিবাসীরা হুট করে নিজেরাই নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ বলে দাবী করে বসেনি। জাতিসংঘ

জুম্মবির অতীত কথা ও স্মৃতি

তারাচরন চাকমা জুম্মবিতে লেখার, বলার ও প্রকাশ করতে সাহজ ও উৎসাহ দিয়ে সবসময়  সাথে থাকবেন। জুম্ম ঘরে জন্ম হওয়াতে তার নাম জুম্মবি। জুম্মবির তেরোটি জাতি সত্বার দশ ভাষার ছোট একটি দেশ জুম্ম দেশ। দশ ভাষায় কথা বলাতে তাকে ভাষাবিও ডাকা হয়। চার দিকে সবুজ সবুজ মুড়ো ও পাহাড় নিয়ে জুম্মবির জুম্মদেশে প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সাইনো তিব্বতী মঙ্গোলয়ড ১৩ টি জাতিগোষ্ঠী এখানে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেছে। প্রায় ৫,০০,০০ (পাঁচ লক্ষ)জনসংখ্যার অভিবাসী জুম্মজাতি প্রধান দু'টি হলো চাকমা এবং মারমা। এরা ছাড়াও আছে ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, পাংখো, ম্রো, খিয়াং, বম,খুমি, চাক,গুর্খা, আসাম। খুব সুখে ছিল সেখাানে তারা। জুম্মবির জুম্মদেশে দশ ভাষা ভাষি তেরোটি জাতি ছাড়া অন্য কোন জাতি ছিল না। ১৫৫০ সালের দিকে প্রণীত বাংলার প্রথম মানচিত্রে বিদ্যমান ছিল। তবে এর প্রায় ৬০০ বছর আগে ৯৫৩ সালে মগধের চম্পক নগরের রাজা উদয় গিরি এই অঞ্চল অধিকার করেন। ১২৪০ সালের দিকে ত্রিপুরার রাজা এই এলাকা দখল করেন। ১৫৭৫ সালে আরাকানের রাজা এই এলাকা পুনর্দখল করেন, এবং ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত অধিকারে রাখেন। মুঘ