সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও ইতিহাস

নিঝুম তালুকদার আদিবাসী প্রসঙ্গ বস্তুতঃ বাংলাদেশে ‘ইন্ডিজেনাস’ বা ‘আদিবাসী’ কারা তা একটি মীমাংসিত বিষয়। কিন্তু তারপরও সরকার ও বাঙালী জাত্যাভিমানী-সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন একটি গোষ্ঠী জেনেও না জানার ভান করে আদিবাসী নিয়ে বিতর্কের অবতাড়না করছে। বিষয়টিকে জটিল রূপ দিয়েছে। ‘আদিবাসী’ বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল বা বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে সরকার আদিবাসীদের ন্যায্য অধিকারকে অস্বীকার করতে চাইছে অথবা তার দায়দায়িত্ব থেকে সরে যেতে চাইছে। অন্য কোন দেশে এমন হয়নি। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ এবং গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তি বলে দাবীদার আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছে। আবার বলা যেতে পারে, সরকার বর্তমানে আদিবাসী বিষয়ে ও আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে বা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। অথবা আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে সরকার যে চরম রক্ষণশীল, এমনকী প্রতিক্রিয়াশীল- তার মুখোশই উন্মোচিত হয়েছে। এ জন্য এই সরকারকে একদিন মাশুল দিতে হবে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের আদিবাসীরা হুট করে নিজেরাই নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ বলে দাবী করে বসেনি। জাতিসংঘ

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও ইতিহাস

নিঝুম তালুকদার


আদিবাসী প্রসঙ্গ


বস্তুতঃ বাংলাদেশে ‘ইন্ডিজেনাস’ বা ‘আদিবাসী’ কারা তা একটি মীমাংসিত বিষয়। কিন্তু তারপরও সরকার ও বাঙালী জাত্যাভিমানী-সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন একটি গোষ্ঠী জেনেও না জানার ভান করে আদিবাসী নিয়ে বিতর্কের অবতাড়না করছে। বিষয়টিকে জটিল রূপ দিয়েছে। ‘আদিবাসী’ বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল বা বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে সরকার আদিবাসীদের ন্যায্য অধিকারকে অস্বীকার করতে চাইছে অথবা তার দায়দায়িত্ব থেকে সরে যেতে চাইছে। অন্য কোন দেশে এমন হয়নি। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ এবং গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তি বলে দাবীদার আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছে। আবার বলা যেতে পারে, সরকার বর্তমানে আদিবাসী বিষয়ে ও আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে বা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। অথবা আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে সরকার যে চরম রক্ষণশীল, এমনকী প্রতিক্রিয়াশীল- তার মুখোশই উন্মোচিত হয়েছে। এ জন্য এই সরকারকে একদিন মাশুল দিতে হবে।বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের আদিবাসীরা হুট করে নিজেরাই নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ বলে দাবী করে বসেনি। জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৯৩ সালকে ‘বিশ্বের আদিবাসী জনগণের আন্তর্জাতিক বর্ষ’, ৯ আগস্টকে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ এবং ১৯৯৫ সাল হতে ২০০৪ সাল সময়কে ‘বিশ্বের আদিবাসী জনগণের প্রথম আন্তর্জাতিক দশক’ হিসেবে ঘোষণার পর থেকে বিশ্বের ও দেশের অপরাপর আদিবাসীদের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণও এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে আসছে।

সেই থেকেই এই পরিচয়টি আরও অধিকতর সামনে এসেছে। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদেরকে অনেক আগেই ‘আদিবাসী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, উক্ত শাসনবিধির তফসিলে উল্লেখিত বিভিন্ন আইনসমূহের মধ্যে দি ইন্ডিয়ান ইনকাম ট্যাক্স এ্যাক্ট ১৯২২, দি ইন্ডিয়ান ফিনান্স এ্যাক্ট ১৯৪১, দ্য ফরেস্ট এ্যাক্ট ১৯৭২ প্রভৃতির ক্ষেত্রেও ‘আদিবাসী পাহাড়ী’ শব্দটি উল্লেখ করা হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে, এমনকী সাম্প্রতিক কালেও সরকারের পক্ষ থেকে এবং সরকারী বিভিন্ন দলিলে বাঙালী জনগোষ্ঠী ব্যতীত বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্যান্য ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোকে ‘আদিবাসী’ বলে অভিহিত করা হয়ে আসছিল। বর্তমান সরকারী দল আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও ‘আদিবাসী’ আখ্যাটি ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের বিশিষ্ট প্রগতিশীল সাহিত্যিক প্রয়াত আহমদ ছফা ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত তার জীবনের প্রথম প্রবন্ধ ‘কর্ণফুলীর ধারে’তে পাহাড়ী মানুষদের ‘আদিবাসী’ হিসেবেই অভিহিত করেছিলেন।

কিন্তু জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের দশম অধিবেশনে জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি মোঃ ইকবাল আহমেদ মন্তব্য করেন, ‘বাংলাদেশে কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠী নেই।’ ২০১১সালের জুলাই মাসের ২৬ তারিখে বিভিন্ন দেশের কুটনীতিক, উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি এবং সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে এক ব্রিফিং অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি নাটকীয়ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী অধিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে বিবেচনা না করতে এবং তার পরিবর্তে ‘ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী’, ‘ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী' হিসেবে অভিহিত করার আহ্বান জানান। দীপু মনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় কোন আদিবাসী নেই। ঐ এলাকার অধিবাসীরা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী।’ জানা যায়, বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রাক্কালে বাংলাদেশের আদিবাসীদের যাতে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া না হয় তার জন্য সরকারী একটি বিশেষ মহল অত্যন্ত তৎপর ছিল। বস্তুত সরকার এদেশের সংখ্যালঘু জাতিগুলো ‘আদিবাসী’ নয় এই দাবীর পেছনে প্রধানত দু’টি যুক্তি উপস্থাপন করছে। প্রথমত, তারা এ অঞ্চলের আদিম বাসিন্দা নয়। তারা সবাই বাংলাদেশের ভূখন্ডের বাইরে থেকে এসেছে। বাঙালীরাই এদেশের প্রকৃত আদিবাসী। দ্বিতীয় যুক্তিটি হচ্ছে, এ জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়, ভাবমূর্তি ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকী সৃষ্টি করবে। প্রকৃত প্রস্তাবে উভয় যুক্তিই খোঁড়া এবং ভিত্তিহীন। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ধরনের আদিবাসী জাতির বসবাস রয়েছে। সে সমস্ত দেশের আদিবাসীদের ভূমি ও সম্পদের অধিকারসহ অনেক অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে। সেই দেশের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়, ভাবমূর্তি ও সার্বভৌমত্বের জন্য কোন প্রকার হুমকী সৃষ্টি হয়েছে বলে তো নজির নেই। সম্ভবত বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশী তাদের জাতীয় পরিচয়, ভাবমূর্তি ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে ব্যস্থ থাকে। এটা এক ধরনের জনবিচ্ছিন্নতা অথবা জনগণের প্রতি অবিশ্বাসেরই বহিঃপ্রকাশ। আর কথায় কথায় সার্বভৌমত্বের দোহাই দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের ন্যায্য দাবীকে বা অধিকারকে ও আন্দোলনকে উপেক্ষা করা এবং দমন-পীড়ন করা বাংলাদেশ সরকারসমূহের একটা সাধারণ অপকৌশল। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ব পর্যন্ত এই সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও তথাকথিত বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনের কাজের অংশ হিসেবে জুম্ম জনগণের ন্যায্য দাবীকে পদদলিত করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে অনেক তান্ডবলীলা চালালো হয়েছিল। আর এদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দানের ক্ষেত্রে ‘জাতীয় পরিচয়, ভাবমূর্তি ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকী সৃষ্টি’র অজুহাতটি সেই পুরানো অপকৌশলেরই অংশ বৈ কিছু নয়। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরা এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দা নয়, তারা ছিল অভিবাসী-এই যুক্তিতে জুম্মদেরকে বা অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিসমূহকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে অস্বীকৃতি জানানো হচ্ছে।

সরকার মূলত আন্তর্জাতিক দলিলে গৃহীত ‘ইন্ডিজেনাস’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘আদিবাসী’ শব্দকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কেবল ‘আদিম বাসিন্দা’ বা ‘প্রাচীন অধিবাসী’ এই ধারণার সাথে গুলিয়ে ফেলছে বা অপব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে। অপরদিকে বাংলাদেশের ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস বিকৃতির অপপ্রয়াসও চালানো হচ্ছে। বস্তুত ‘আদি বাসিন্দা’ এই ধারণার সাথে ‘ইন্ডিজেনাস’ বা ‘আদিবাসী’ পরিচয় বা সংজ্ঞার মধ্যে মুখ্যত কোন সম্পর্ক নেই।
প্রসঙ্গক্রমে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বর্তমান ‘ইন্ডিজেনাস’ বা ‘আদিবাসী’ এর সংজ্ঞা স্মরণ করা যাক। এখানে জাতিসংঘের স্পেশাল র‌্যাপোটিয়র জোসে মার্টিনেজ কোবো’র ১৯৮৪ সালে প্রদত্ত সংজ্ঞাটি যা জাতিসংঘ ‘ওয়ার্কিং ডেফিনিশন’ হিসেবে গ্রহণ করেছে তা উল্লেখ করা যাক। এতে বলা হয়েছে যে- ‘আদিবাসী সম্প্রদায়, জনগোষ্ঠী ও জাতি বলতে তাদেকে বুঝায় যাদের ভূখন্ডে প্রাক-আগ্রাসন এবং প্রাক-উপনিবেশিক কাল থেকে বিকশিত সামাজিক ধারাসহ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে যারা নিজেদেরকে উক্ত ভূখন্ডে বা ভূখন্ডের কিয়দংশে বিদ্যমান অন্যান্য সামাজিক জনগোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র মনে করে। বর্তমানে তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীভুক্ত এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও আইনী ব্যবস্থার ভিত্তিতে জাতি হিসেবে তাদের ধারাবাহিক বিদ্যমানতার আলোকে তারা তাদের পূর্ব-পুরুষদের ভূখন্ড ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ভবিষ্যত বংশদরদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মোট কথা আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা বহিরাগত কর্তৃক দখল বা বসতিস্থাপনের পূর্ব থেকে নির্দিষ্ট ভূখন্ডের মূল অধিবাসীর বংশধর।’
অপরদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কনভেনশন নং ১৬৯ এর সংজ্ঞা অনুয়ায়ী- ‘স্বাধীন দেশসমূহের জাতিসমূহ- যারা এই মর্মে আদিবাসী হিসেবে পরিগণিত যে, তারা ঐ দেশটিতে কিংবা দেশটি যে ভৌগলিক ভূখন্ডে অবস্থিত সেখানে রাজ্য বিজয় কিংবা উপনিবেশ স্থাপন কিংবা বর্তমান রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারণ কাল থেকে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর বংশধর, যারা তাদের আইনগত মর্যাদা নির্বিশেষে নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর অংশবিশেষ বা সম্পূর্ণ লালন করে চলেছে।’
বলাবাহুল্য, উক্ত সংজ্ঞায় কোথাও আদিবাসী হওয়ার জন্য আদিম বাসিন্দা হওয়ার শর্ত নেই। আর প্রাক-আগ্রাসন ও প্রাক-উপনিবেশিক কাল থেকে এবং উপনিবেশ স্থাপন কিংবা বর্তমান রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারণেরও বহু কাল আগে থেকে যে জুম্মরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে আসছে তাতো দিবালোকের মত সত্য। আর জুম্মরাই যে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত প্রাচীন স্থায়ী অধিবাসী- ইতিহাসও তারই স্বাক্ষ্য দেয়। এই ধরনের প্রসঙ্গ গত মাসে জুম্মবিতে অনেকবার আলোচনা করা হয়েছে। যাই হোক, আদিবাসী বলতে বস্তুত দেশে দেশে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অধিকারী সংখ্যালঘু বা প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীগুলোকেই তুলে ধরা হয়েছে। আর এটা কোন জাতিগত পরিচয়ও নয়। এই অভিধার মধ্য দিয়ে মূলত এ সমস্ত জাতিগোষ্ঠীগুলোর সংকটময় প্রান্তিক অবস্থাকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। আর ‘ইন্ডিজেনাস’ ও ‘ট্রাইবাল’- উভয়ই সেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেই তুলে ধরে।উল্লেখ্য, সরকার ও জাত্যাভিমানীদের কাছে, ‘উপজাতি’ শব্দটিই অধিক পছন্দের। ‘ট্রাইবাল’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত ‘উপজাতি’ শব্দটি এখন বিতর্কিত এবং সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তবুও সরকারীভাবে প্রচলিত রয়েছে বলে জনগণ তা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। আর অতীতে মূলত নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় ব্যবহৃত হলেও এখন তার অর্থ অন্যভাবে বা অপমানজনকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা যতটা না নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, তার চেয়ে বেশী এদেশের স্বতন্ত্র সংস্কৃতির অধিকারী জাতিসমূহকে ‘হেয় প্রতিপন্ন করা’, ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক জ্ঞান করা’, তাদের অগ্রগতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা দমন করার উদ্দেশ্যেই তারা এটা চাপিয়ে দিতে চায়। না হলে তাদের স্বার্থটা কোথায়? এটা এক ধরনের বর্ণবাদী, জাত্যাভিমানী ও আগ্রাসী মানসিকতা।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও অপপ্রচার প্রসঙ্গ


বাংলাদেশে ইতিহাস বিকৃতির চর্চা একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত সংকীর্ণ ও কায়েমী স্বার্থবাদী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এই অপসংস্কৃতির উৎপত্তি। এই অপসংস্কৃতিটি বাংলাদেশের জনগণের মনে, মননে যথেষ্ট ক্ষতি করছে। এর কাজ হলো মূলত একটি সংকীর্ণ ও কায়েমী স্বার্থ হাসিল করা, অপরের মত ও অধিকারকে অসম্মান ও অবদমিত করা, সত্য ও মিথ্যাকে গুলিয়ে দেয়া অথবা সত্যকে চাপা দিয়ে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যর্থ অপচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। আর এই অপসংস্কৃতির অসুখে আক্রান্ত বাংলাদেশের সবকটি বড় রাজনৈতিক দল। আর এর দ্বারা সংক্রমিত অনেকেই। এটা দেশের গণতন্ত্রায়নে ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে ভেতর থেকে আঘাত হানছে।

এই ইতিহাস বিকৃতির অপসংস্কৃতি বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বস্তুত এটা জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব নিয়ে ষড়যন্ত্রেরই একটা অংশ। সেই ষড়যন্ত্র আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। আর সেই ষড়যন্ত্রের গতিবেগ আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে যখন স্বয়ং সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এদেশে কোন আদিবাসী নেই, আদিবাসী যদি কেউ থাকে তাহলে বাঙালীরাই প্রকৃত আদিবাসী। লক্ষণীয় ব্যাপার এই আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের দিকেই বেশী। নানা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে, বই বের করে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে- পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা এদেশের অর্থাৎ বাংলাদেশের স্থায়ী অধিবাসী নয়। এজন্য সত্যমিথ্যা মিশিয়ে অনেক উদ্দেশ্যমূলক ও আক্রোশমূলক কাহিনী বা বক্তব্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। সেসব বক্তব্য রীতিমত ইতিহাস বলে প্রচার করা হচ্ছে।

নিম্নে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তিকর, পক্ষপাতমূলক ও মিথ্যা তথ্য ও ব্যাখ্যার কয়েকটি নমুনা তুলে ধরা যাক।

(১)জনৈক জামাল উদ্দিন কর্তৃক লিখিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস’ নামে একটি বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে-‘পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রামের চিরকালীন অখন্ড ভৌগলিক অঞ্চল। অতীতে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে এ অঞ্চল প্রতিবেশী রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু কখনো ভিন্ন দেশের অংশে পরিণত হয়নি, চিরকালই নামে চট্টগ্রাম এবং ভৌগলিক পরিচয়ে বাংলার আদি অখন্ড অঞ্চল হিসেবে ছিল এবং এখনও রয়েছে।’

‘কুকি-চীন ভাষাভাষিদের পরে এ অঞ্চলের উত্তরাংশে উত্তর দিক থেকে আসে বরো ভাষাভাষি ত্রিপুরাদের রিয়াং জনগোষ্ঠীর লোকেরা।….রিয়াংদের পরে চাকমারা অষ্টদশ শতকে চট্টগ্রামের অঞ্চলে প্রবেশ করে।’‘১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলী খাঁ এ প্রদেশের রাজস্ব সংগঠনকে পুনর্গঠন করেন। তখন বৃহত্তর চট্টগ্রাম (পার্বত্য অঞ্চলসহ) অঞ্চলটি ইসলামাবাদ চাকলায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।’
‘উপজাতি বলতে এখন যাদেরকে বোঝানো হয়, তাদের পূর্ব পুরুষেরা বাইরে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে এসে বসবাস করতে শুরু করে শ’দুয়েক বছর পূর্বে।’ বাংলাদেশ ভূখন্ডে সাঁওতালদের আগমনকাল একশ বছরের মত।’
(২) অপরদিকে জনৈক সাহাদত হোসেন খান কর্তৃক রচিত ‘পার্বত্য উপজাতিদের আদি নিবাস’ নামে অপর একটি বইয়ে আরও বেশী আপত্তিকর, উস্কানিমূলক ও বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। বইটির বিষয়বস্তু ও বিশ্লেষণ অত্যন্ত নিম্নমানসম্পন্ন এবং চরমভাবে পক্ষপাতদুষ্ট।
‘শাব্দিক অর্থে চাকমা হচ্ছে একটি পার্বত্য যাযাবর সম্প্রদায় অথবা অজ্ঞাত বংশোদ্ভূত লোক যারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল এবং বাংলাদেশ ছাড়া অন্যান্য জায়গা থেকে তারা বিতাড়িত হয়।’সুতরাং তারা হলো বহিরাগত ও শরণার্থী।’চাকমাদের আদিভূমি খুঁজে বের করা সত্যি অসম্ভব।’
‘এসব বিবরণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, চাকমারা হচ্ছে বহিরাগত এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রিত একটি জনগোষ্ঠী যাদের ভাষা, ইতিহাস এমনকি পরিচিতি বিভ্রান্তিকর এবং অজানা। এটাই ভাগ্যের পরিহাস যে, এ ধরণের নাম পরিচয়হীন একটি সম্প্রদায় দেশের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে জন বসতির ইতিহাস নিয়ে প্রচুর প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও বইপত্র লেখা হয়েছে। কিন্তু এসব লেখালেখির গভীরতা খুব কম। প্রকাশিত লেখালেখিগুলো গবেষণামূলক হলে নিঃসন্দেহে এ খন্ডনীয় সত্য প্রমাণিত হতো যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুসলমানরাই হলো প্রথম বসতিস্থাপনকারী এবং বাংলাদেশ হলো এ ইতিহাসের বৈধ উত্তরাধিকারী।’ ‘চাকমা অথবা পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্য কোন উপজাতি ইংরেজদের উপর হামলা চালায়নি।’ ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ও টাঙ্গাইলের মধুপুরে গারো পাহাড়ে বসবাসকারী উপজাতীয়রা বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানায় বসবাস করলেও প্রতিবেশী ভারত ও বাইরের রাষ্ট্রের প্রতি তারা কমবেশী দুর্বল। বাইরের দেশগুলোও তাদের মদদ দিচ্ছে। লক্ষ্য করলে একটি সত্য পরিষ্কার ধরা পরে যে, যারা বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানা পরিবর্তন করতে চায়, তাদের একজনও মুসলমান নয়।’ জুম্মবির সকল পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন যে, উক্ত লেখাসমূহে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ইতিহাসের উপর কীভাবে আঘাত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। ইতিহাসের নামে কী মিথ্যার বেসাতি করা হয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদেরকে কী হিংসার চোখে দেখা হয়েছে। জৈনক সাহদাত হোসেন খান লিখেছেন -
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কয়েক হাজার বছর আগে থেকে আমাদের মুসলমানরাই বসবাস করে আসছে। মুসলমানরাই হলো এ অঞ্চলের প্রথম বসতিস্থাপনকারী এবং বাংলাদেশ হলো এ ইতিহাসের বৈধ উত্তরাধিকারী।’ জুম্মবির পাঠকগন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ইতিহাসের সাল কারোর অজানা নয়। একজন শিশুও তা জানে। অথচ জৈনক সাহদাত হোসেন খান কেন বুঝতে চাচ্ছেন না বাংলাদেশের মুসলিম ইতিহাস। সমগ্র পৃথিবীব কথা নয় ভারত বর্ষে প্রথম প্রতিষ্ঠিত প্রাতিস্থানিক ধর্ম হলো
ব্রাহ্মনধর্ম (আজকাল যাকে ‘হিন্দুধর্ম’ বলা হয়)। ভারতবর্ষে এই ধর্মের প্রভাব খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১৫০০ বছর থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৭বছর পয্যন্ত লক্ষ্য করা যায়। বুদ্ধ (৫৮৭- ৫০৭ খ্রিস্ট পূর্ব) তাঁর ধর্ম প্রচারের ফলে এই ধর্মের প্রভাব সমাজে অনেকটা নিস্প্রভ হয়ে পড়ে। শুরু হয় ভারতবর্ষে সামাজিক বিপ্লব ও বৌদ্ধ সভ্যতা।

বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের জন্ম (নেপালের লুম্বিনি উদ্যান) যীশু খ্রিস্টের জন্মের ৬২৩ বছর আগে, অর্থাৎ আজ থেকে (২০১৭+ ৬২৩) =২৫৪০বছর আগে বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তন হয়।
খ্রিস্টানধর্মের প্রবর্তক যীশু খ্রিস্টের জন্ম (বর্তমান ইসরাইলের বেথ্যালহেম শহর) হয়েছিল আজ থেকে ২০১৭ বছর আগে, অর্থাৎ আজ থেকে ২০১৭ বছর আগে খ্রিস্টানধর্মের প্রবর্তন হয়।
ইসলামধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহম্মদের জন্ম (বর্তমান আরবের মক্কা শহর) যীশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৬০০ বছর পরে, অর্থাৎ আজ থেকে (২০১৭–৬০০=) ১৪১৭বছর আগে ইসলামধর্মের প্রবর্তন হয়। অর্থাৎ বৌদ্ধধর্মের (২৫৪০–১৪১৭=) ১১২৩বছর পরে ইসলামধর্মের আবির্ভাব হয়।
যীশু খ্রিস্টের জুন্মের ৫০০ বছর আগ থেকে ১২০০ শতাব্দী পয্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ১৭০০ বছর (কম সময় নয়) ছিল ভারতবর্ষে বৌদ্ধ সভ্যতার ইতিহাস। এই সময় ভারতবর্ষের (বর্তমান ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল বৌদ্ধ। হিন্দু ও জৈনরা ছিলেন ধর্মীয় সংখ্যালগু। এখানে একজন মুসলিমও ছিলনা। ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধধর্ম মধ্য এশিয়া (বর্তমান আফগানিস্থান, উজবেকস্থান, কাজাকস্থান, দক্ষিন রাশিয়া, মধ্য প্রাচ্যের কিছু দেশ–যেমন ইরাক, ইরান, সিরিয়া ইত্যাদি), পূর্ব ইউরোপ, তিব্বত, চীন, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, যাবা, সুমাত্রা ও বর্ণীয়ও দ্বীপপুঞ্জ (বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া ও মালএশিয়া), বার্মা ও শ্রীলঙ্কায় বিস্তার লাভ করে। এর পেছনে সবচেয়ে বেশী কাজ করেছিলেন সম্রাট অশোক (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী) এবং অগণিত শান্ত ও সোম্য বৌদ্ধভিক্ষু ও পণ্ডিত। এই ধর্ম প্যৃথিবীর যেদিকে গেছে সেদিকে মানুষকে সভ্য করে তুলেছে, দিয়েছে শান্তি, মৈত্রী, করুণা, প্রেম ও প্রজ্ঞার আশ্বাস এবং সঠিক জীবনের অর্থ।
১২০০ সালে বখতিয়ার খিলজি বর্তমান বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ আক্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ভারতবর্ষে প্রকৃত মুসলিম সাম্রাজ্য। আরব দুনিয়া থেকে মুহম্মদের আর্মি “এক হাতে তলোয়ার এক হাতে কোরান” নিয়ে এসে জেহাদ (অমুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ) করতে করতে বর্তমান আফগান্তিস্থান, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ আক্রমণ করে বেদখল করে নেয়। বৌদ্ধ, হিন্দু ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের গণহত্যা করে। কেও মারা গেল, কেও পালিয়ে গেল আর যারা বাকী ছিল তাদেরকে জোরপূর্বক ইসলামধর্মে ধর্মান্তরিত করল। নয়তলা এবং ৩০০০০ বৌদ্ধ শিক্ষক ও ছাত্র বিশিষ্ট বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দাসহ, বিক্রমশীলা, তক্ষশীলা এবং ভারতবর্ষের সমস্ত বৌদ্ধ মন্দির, শিক্ষা প্রতিস্থান, শিল্পকলা, কারুকায্য ও সভ্যতা ধ্বংস করে দিল। কথিত আছে তাদের আক্রমনে বৌদ্ধধর্মের এত ক্ষতি হয়েছিল যে ভারতবর্ষের মাটীতে বৌদ্ধধর্মের একটা পুস্তকও পাওয়া যায়নি;
আজকাল আমরা বৌদ্ধধর্মের যে বই পড়ছি সেগুলো সব তিব্বতী, চীনী, সিংহলী ভাষা থেকে প্রথমে ইংরেজি ও পরে অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করা গ্রন্থ থেকে পড়ছি। আজকাল আফগানিস্থান, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে যারা নিজেদেরকে ‘মুসলিম’ বলে পরিচয় দিচ্ছে তাদের পূর্বসুরীরা সবাই ১২০০ সালের আগে বৌদ্ধ বা হিন্দু বা জৈন ছিলেন। ১২০০ সাল থেকে বর্তমান পর্য্যন্ত হিসাব করলে ( ২০১৭-১২০০)= মাত্র ৮১৭ বছর অাগে বৌদ্ধ, হিন্দু বা জৈনরা বাধ্য হয়ে বর্তমান বাংলাদেশে ইসলাম গ্রহন করেছিল। তাহলে সাহদাত খান না জেনে কেন লিখেছেন যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কয়েক হাজার বছর ধরে মুসলমানরাই বসবাস করে আসছে। মুসলমানরাই হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রথম বসতিস্থাপনকারী এবং বাংলাদেশ হলো এ ইতিহাসের বৈধ উত্তরাধিকারী।’ এই কথাটি সম্পুর্ণ মিথ্যে এবং বানোয়াত।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চাকমাদের খাঁ, রায়, খীসা, দেওয়ান ও তালুকদার উপাধি

নিঝুম তালুকদার আমি পুর্বের আলোচনাতে চাকমা রাজ বংশের বংশানুক্রমিক ও পিরি নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আর নতুন করে সে বিষয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন নেই। তাই সংক্ষেপে আলোচনা শুরু করছি। সবাই সাথে থাকুন। পড়তে থাকুন। জনু রাজার পুত্র ছিল না―শুধু দুই কন্যা। জনু রাজা ১২০ বৎসর পৰ্যন্ত জীবিত ছিলেন। বড় কন্যা সাজোম্বীকে মগ রাজা বিবাহ করে। দ্বিতীয় কন্যা রাজেস্বীকে বুড়া বড়ুয়া বিবাহ করেন। বুড়া বড়ুয়ার পুত্র সাত্তুয়া রাজা হন। তিনি পরে পাগলা রাজা বলে প্ৰসিদ্ধ হন। পাগলা রাজা অতিশয় জ্ঞানী ছিলেন। কথিত আছে মন্ত্র বলে তিনি চিৎকলিজা বের করে ধৌত করে আবার ঢুকিয়ে রাখতেন। এই কার্য করতে তাঁর রাণী উকি দিয়ে দেখলে, তিনি আর ঢুকাতে পারলেন না। তাঁতে প্রকৃত পাগল হন। যাকে তাকে কাটতে লাগলেন। সেজন্য তার রাণীর সম্মতিতে তাকে হত্যা করা হয়।  প্ৰবাদ আছে- "তিনি একদিন টংগীতে বসেছিলেন এবং জংগলী হাতী এসেছে বলে পূর্ব প্ৰস্তাব মতে মিথ্যা রটনা করাতে বন্য হাতী দেখবার জন্য মাথা বের করলেন। তখন পেছনদিক হতে তার শিরচ্ছেদ করা হয়।" পাগলা রাজার মৃত্যুর পর রাণী রাজকাৰ্য চালান। “কাটুয়া কন্যার” আমল বলে তার দুর্না

কাপ্তাই বাঁধ ও রড়পোরং

নিঝুম তালুকদার কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ পার্বত্যঞ্চলের এক বেদনাদায়ক যুগান্তকারী ঘটনা। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে এই বাঁধ নির্মাণ এই অঞ্চলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়। বিষয়টি এখনও বির্তকিত রয়েছে। পৃথিবীর অনেক আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে উন্নয়নের নামে যে সব প্রকল্প ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বির্পযয় ও বিলুপ্তির জন্য দায়ী কাপ্তাই বাঁধ তন্মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এই বাঁধ অত্রাঞ্চলে পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক বিপর্যয়।  পার্বত্য অঞ্চলের জৈব্য বৈচিত্র্য, পরিবেশ ধ্বংস ছাড়াও চাকমা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকজনকে বিলুপ্তির কাছাকাছি এনেছে কাপ্তাই বাঁধ। কাপ্তাই বাঁধ পার্বত্যঞ্চলের জনগণের তথা চাকমা জনগোষ্ঠীর দূর্গতির মূল কারণ। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নের নামে নির্মিত এই বাঁধ পার্বত্য অঞ্চলের অন্যতম আদিবাসী জনগোষ্ঠী চাকমা সম্প্রদায়কে বিলুপ্তি ও ধ্বংসের প্রান্তে এনেছে। আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে এই বাঁধ নির্মিত হলেও এর বিরুপ প্রভাব এখনও বিদ্যমান। ভৌগলিক, পরিবেশগত ও জৈব্য বৈচিত্র্যের উপর এর অবর্ণনীয় ক্ষতিকর প্রভাব হাজার বছরব্যাপী অত্রাঞ্চলে বিরাজ করবে। বাঁধ নির্মাণ কার্য যারা প্রত্যক্ষ

চাকমা জাতির এক মহীয়সী নারী চাকমা রাণী কালিন্দী

 ইলিরা দেওয়ান চাকমা রানী কালিন্দী কে নিয়ে সকলের মুখে প্রায়ই শোনা যায় যে চাকমা রাণী কালিন্দীর কারনে চাকমা জাতি রাজ্যহারা। তারই ভুলের জলন্ত আগুনের মশালে দহনীয় সমগ্র চাকমা জাতি। রাণী কালিন্দীর বিরদ্ধে সবার মাঝে যে ধারনা সেই বিষয় নিয়ে আজকের সংক্ষিপ্ত আলোচনা । সবাই সাথে থাকুন। পড়তে থাকুন।  বৃটিশ আমলে উপমহাদেশের মহীয়সী নারীদের বীরত্ব গাঁথা কিংবা সমাজে তাঁদের অবদানের কথা বললে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে নবাব ফয়জুন্নেসা, বেগম রোকেয়াদের কথা। কিন্তু তাঁদের জন্মেরও পূর্বে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আরেক মহীয়সী নারীর কথা ক’জনইবা জানেন! উনিশ শতকের প্রথমদিকে রাস্তাঘাটহীন দূর্গম পার্বত্য এলাকার কুদুকছড়ির সাধারণ এক চাকমা জুমিয়া পরিবারে জন্মেছিলেন কালাবি চাকমা। পরবর্তীতে চাকমা রাজা ধরম বক্স খাঁ এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তিনি ‘কালিন্দী রাণী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠলেও তিনি স্বশিতি ছিলেন এবং তাঁর প্রাজ্ঞ দিয়ে রাজপরিবারের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে সম হয়েছিলেন। কালিন্দী রাণী শুধু বৈষয়িক বুদ্ধিতে কিংবা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দূরদর্শিতায় প্রাজ্ঞ ছিলেন না, এর পা

চাকমা রাজবংশের ইতিহাস (২য় পর্ব)

নিঝুম তালুকদার যা গতকালকের আলোচনায় আজুর সত্যি ঘটনার গল্পের কাহিনীতে "চাকোমাস" নামে যে চাকমাদের রাজ্যের নামটি উল্লেখ করা হয়েছিল সেটির ইতিহাস সুত্র ধরে আজুর সত্য ঘটনার গল্পের কাহিনীর সাথে অনেকের ইতিহাস লেখকের লেখা কাহিনীর সাথে মিল পেয়েছি। কারণ বহু লেখক লিখেছেন চাকমাদের রাজ্যের নাম "চাকোমাস"। এবং কিছু কিছু ঘটনাবলীও অনেক মিল রয়েছে। আরো একটি কাহিনী মিলিয়ে দেখুন।  চাকমা রাজপরিবার লিখেছেন-- সুশীল প্রসাদ চাকমা , রাঙ্গামাটি তিনি যা যা লিখেছেন সেগুলোর কপি দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসের সূত্র মতে, হিমালয়ের পাদদেশে শাক্য নামে এক রাজা বাস করতেন। তার রাজধানী ছিল কালপ্পানগর। সেখানে ঈশ্বরের মূর্তি তৈরি করে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন তিনি। যানকুনী মন্ত্রীর জন্ম ওই পরিবারে। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে রাজ্য চালানোর জন্য তার খ্যাতি ছিল ব্যাপক। সুধন্য নামে শাক্য রাজার ছিলেন এক সাহসী ছেলে। তিনি ক্ষত্রীয় বীরদের মতো শত্রুদের দমন করতেন। রাজা সুধন্যর দুই রাণী ও তিন পুত্র সন্তান ছিল। প্রথম রাণীর ছেলে গুণধর রাজকীয় আনন্দ ত্যাগ করে মোহমুক্তির উদ্দেশ্যে সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করেন। কনিষ্ঠ রাণীর আনন্

চাকমা রাজবংশের ইতিহাস

নিঝুম তালুকদার আমরা তখন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরনার্থী অবস্থায় ছিলাম। সেখানে অনেক ছেলে- মেয়েকে আমার আজু প্রায়ই গল্প শুনাতেন। একদিন আজু আজকের আলোচনা বিষয়টি সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক সত্য ঘটনার গল্প বলেছিলেন। আজু যে ভাবে বলেছিলেন ঠিক সেইভাবে ঐ ঘটনার কথা নিয়ে আজকে আলোচনা করতে যাচ্ছি। সবাই সাথে থাকুন। চাকমা রাজপরিবার ইতিহাস অনুসারে সময়টা আনুমানিক ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগ। চম্পক নগরের রাজা সাংবুদ্ধ। সাংবুদ্ধর দুই ছেলে- বড় ছেলের নাম বিজয়গিরি এবং ছোট ছেলের নাম সমরগিরি। যুবরাজ বিজয়গিরি যুদ্ধবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। ছেলেবেলা হতেই তিনি রাজ্য জয় ও রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখতেন। চম্পক নগরের ভাবি রাজা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন।  ত্রিপুরার দক্ষিনে অবস্থিত মগ রাজ্য। মগরা ছিল দুস্য প্রকৃতির। তারা শহর ও গ্রামে লুন্ঠণ এবং মানুষের ওপর অত্যাচার করে বেড়াত । ত্রিপুরা রাজের অধিভূক্ত দক্ষিনাঞ্চলেও তাদের দৌরাত্ম্য থেকে মুক্ত ছিল না । এসময় ত্রিপুরা রাজ্যে অন্তঃবিপ্লবের সম্ভাবনা থাকায় রাজা মগদের দমনে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেনি। যুবরাজ বিজয়গিরি তার সামরিক অভিযানের

চাকমা রাজবংশের বিজক ও পিরি

নিঝুম তালুকদার ৫১তম চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের রাজপিরি ও বিজোগ বিগত কয়েক দিন আগে আমার আলোচনা পোষ্টে "চাকমা রাজবংশের ইতিহাস"টি নিয়ে বিভিন্ন মহলের আরো চাকমা রাজবংশের ইতিহাস সর্ম্পকে জানার আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। তাতে আমারও উৎসাহ অগ্রসর হয়। আমিও উৎসাহ নিয়ে বিজোক ইতিহাস ঘাটাঘাটি করি। ইতিহাস সুত্রমতে বর্তমান চাকমা সার্কেলের রাজা দেবাশীষ রায়ের আমলে তিনি ৫১তম চাকমা রাজা যেভাবে হলেন তা নিয়ে আলোচনা শুরু করি। ০১. অতি পুর্বকালে হিমালয়ের পাদদেশে শাক্য নামে এক রাজা ছিলেন। কলাপ্যা নগর তার রাজ্যের রাজধানী ছিল। তিনি ঐ নগরে ঈশ্বরের এক মূর্তি প্ৰস্তুত করিয়ে পূজা করতেন। ঐ রাজার বংশজ মন্ত্রীর নাম সাংকুস্য। মন্ত্রীরাজ রাজধানী শাসনের ভার নিয়ে দুষ্ট দমন করে সাবধানে প্রজা পালন করতেন। ০২. শাক্যরাজার পুত্ৰ সুধন্য মহা তেজস্বী হয়ে সর্বদা ক্ষত্ৰিয়ভাবে রিপু দমন করে বীর ভাব প্রকাশ করে থাকতেন। সাংকুস্য মন্ত্রীর পুত্ৰ জয়ধন সেনাপতির সংগে মহারাজ সুধন্য যুদ্ধসজ্জায় সর্বদা সজ্জিত থাকতেন এবং শত্রু দমনে সাবধান থাকতেন। সুধন্য মহারাজের দুই রাণী, তিন পুত্র ছিল। বড়রাণীর গর্ভজাত গুণধন রাজভো

জুম্মবির অতীত কথা ও স্মৃতি

তারাচরন চাকমা জুম্মবিতে লেখার, বলার ও প্রকাশ করতে সাহজ ও উৎসাহ দিয়ে সবসময়  সাথে থাকবেন। জুম্ম ঘরে জন্ম হওয়াতে তার নাম জুম্মবি। জুম্মবির তেরোটি জাতি সত্বার দশ ভাষার ছোট একটি দেশ জুম্ম দেশ। দশ ভাষায় কথা বলাতে তাকে ভাষাবিও ডাকা হয়। চার দিকে সবুজ সবুজ মুড়ো ও পাহাড় নিয়ে জুম্মবির জুম্মদেশে প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সাইনো তিব্বতী মঙ্গোলয়ড ১৩ টি জাতিগোষ্ঠী এখানে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেছে। প্রায় ৫,০০,০০ (পাঁচ লক্ষ)জনসংখ্যার অভিবাসী জুম্মজাতি প্রধান দু'টি হলো চাকমা এবং মারমা। এরা ছাড়াও আছে ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, পাংখো, ম্রো, খিয়াং, বম,খুমি, চাক,গুর্খা, আসাম। খুব সুখে ছিল সেখাানে তারা। জুম্মবির জুম্মদেশে দশ ভাষা ভাষি তেরোটি জাতি ছাড়া অন্য কোন জাতি ছিল না। ১৫৫০ সালের দিকে প্রণীত বাংলার প্রথম মানচিত্রে বিদ্যমান ছিল। তবে এর প্রায় ৬০০ বছর আগে ৯৫৩ সালে মগধের চম্পক নগরের রাজা উদয় গিরি এই অঞ্চল অধিকার করেন। ১২৪০ সালের দিকে ত্রিপুরার রাজা এই এলাকা দখল করেন। ১৫৭৫ সালে আরাকানের রাজা এই এলাকা পুনর্দখল করেন, এবং ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত অধিকারে রাখেন। মুঘ

বৃটিশ শাসনে চাকমা জনগোষ্ঠীর সম্পাদনা

নিঝুম তালুকদার পলাশীর যুদ্ধের তিন বছর পরে, মুর্শিদাবাদের নতুন নবাব মীর কাশিম বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে চট্টগ্রাম বর্ধমান এবং মেদিনীপুর উপহার হিসেবে দিয়ে দেন। যেটি গতকাল আলোচনায় বলা হয়েছে। দিনটি ছিল ৫ জানুয়ারী ১৭৬১ সালে, কোম্পানীর প্রতিনিধি হ্যারি ভেরেলস্ট চট্টগ্রামের শাসনভার সুবেদার মোহাম্মদ রেজা খানের কাছ থেকে গ্রহন করেন। তবে তখনো চাকমা রাজা শের দৌলত খান স্বাধীনভাবে তার রাজ্য পরিচালনা এবং মুঘলদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। এবং কোম্পানীর শাসন মেনে না নিয়ে কোম্পানী কর্তৃক ধার্য নির্ধারিত খাজনা প্রদানে বিরত ছিলেন। ফলে কোম্পানির সাথে একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের সূত্রপাত হয়, যা ১৭৮৭ সালপর্যন্ত চলেছিল। কোম্পানী চাকমা রাজের বিরুদ্ধে চারটি যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। সেগুলো হল - ১৭৭০, ১৭৮০, ১৭৮২ এবং ১৭৮৫ সালের যুদ্ধ। যুদ্ধে কোম্পানী বিশেষ সুবিধে করতে না পারায় এবং চাকমা রাজ্যে বাণিজ্য অবরোধের ফলে সৃষ্ট সমস্যায় - দুই পক্ষই ১৭৮৫ সালে একটি শান্তি আলোচনা চালায়। চাকমা রাজের পক্ষে রাজা জানবক্স খান, শের দৌলত খানের পুত্র অংশ নেন। পরবর্তীতে ১৭৮৭ সালে কলকাতায় চাকমা রাজের সাথে কোম্প