সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও ইতিহাস

নিঝুম তালুকদার আদিবাসী প্রসঙ্গ বস্তুতঃ বাংলাদেশে ‘ইন্ডিজেনাস’ বা ‘আদিবাসী’ কারা তা একটি মীমাংসিত বিষয়। কিন্তু তারপরও সরকার ও বাঙালী জাত্যাভিমানী-সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন একটি গোষ্ঠী জেনেও না জানার ভান করে আদিবাসী নিয়ে বিতর্কের অবতাড়না করছে। বিষয়টিকে জটিল রূপ দিয়েছে। ‘আদিবাসী’ বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল বা বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে সরকার আদিবাসীদের ন্যায্য অধিকারকে অস্বীকার করতে চাইছে অথবা তার দায়দায়িত্ব থেকে সরে যেতে চাইছে। অন্য কোন দেশে এমন হয়নি। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ এবং গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তি বলে দাবীদার আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছে। আবার বলা যেতে পারে, সরকার বর্তমানে আদিবাসী বিষয়ে ও আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে বা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। অথবা আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে সরকার যে চরম রক্ষণশীল, এমনকী প্রতিক্রিয়াশীল- তার মুখোশই উন্মোচিত হয়েছে। এ জন্য এই সরকারকে একদিন মাশুল দিতে হবে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের আদিবাসীরা হুট করে নিজেরাই নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ বলে দাবী করে বসেনি। জাতিসংঘ...

চাকমা রাজবংশের ইতিহাস (২য় পর্ব)

নিঝুম তালুকদার


যা গতকালকের আলোচনায় আজুর সত্যি ঘটনার গল্পের কাহিনীতে "চাকোমাস" নামে যে চাকমাদের রাজ্যের নামটি উল্লেখ করা হয়েছিল সেটির ইতিহাস সুত্র ধরে আজুর সত্য ঘটনার গল্পের কাহিনীর সাথে অনেকের ইতিহাস লেখকের লেখা কাহিনীর সাথে মিল পেয়েছি। কারণ বহু লেখক লিখেছেন চাকমাদের রাজ্যের নাম "চাকোমাস"। এবং কিছু কিছু ঘটনাবলীও অনেক মিল রয়েছে। আরো একটি কাহিনী মিলিয়ে দেখুন। 
চাকমা রাজপরিবার
লিখেছেন-- সুশীল প্রসাদ চাকমা, রাঙ্গামাটি
তিনি যা যা লিখেছেন সেগুলোর কপি দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসের সূত্র মতে, হিমালয়ের পাদদেশে শাক্য নামে এক রাজা বাস করতেন। তার রাজধানী ছিল কালপ্পানগর। সেখানে ঈশ্বরের মূর্তি তৈরি করে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন তিনি। যানকুনী মন্ত্রীর জন্ম ওই পরিবারে। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে রাজ্য চালানোর জন্য তার খ্যাতি ছিল ব্যাপক। সুধন্য নামে শাক্য রাজার ছিলেন এক সাহসী ছেলে। তিনি ক্ষত্রীয় বীরদের মতো শত্রুদের দমন করতেন। রাজা সুধন্যর দুই রাণী ও তিন পুত্র সন্তান ছিল। প্রথম রাণীর ছেলে গুণধর রাজকীয় আনন্দ ত্যাগ করে মোহমুক্তির উদ্দেশ্যে সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করেন। কনিষ্ঠ রাণীর আনন্দ মোহন ও লাঙ্গলধন নামে দুই ছেলে ছিল। আনন্দ মোহন সিদ্ধার্থের শিষ্য হয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুর জীবন গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় ছেলে লাঙ্গলধন রাজা হয়ে রাজ্য শাসন করেন। কিন্তু খুব অল্প বয়সে মুত্যুবরণ করেন তিনি। এরপর লাঙ্গলধনের ছেলে সমুদ্রজিৎ বেশ কয়েক বছর রাজ্য শাসন করেন। কিন্তু তিনিও মাত্র বিশ বছর বয়সে রাজত্ব ত্যাগ করে বৌদ্ধ ভিক্ষুত্ব গ্রহণ করেন। এতে তার সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।
এভাবে বংশ পরম্পরায় রাজ্য পরিচালিত হয়ে আসে। আনুমানিক ৫৯০ সালের দিকে চাকমা যুবরাজ বিজয়গিরি ও সেনাপতি রাধামন খীসার নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধে রোয়াং রাজ্য (বর্তমান রামু), অক্সাদেশ (আরাকান সীমান্ত), খ্যয়ং দেশ, কাঞ্চননগর (কাঞ্চন দেশ) ও কালজর (কুকিরাজ্য) প্রভৃতি রাজ্য বিজিত হলে বিশাল ‘পার্বত্য রাজ্য’ এর (চাকোমাস) পত্তন ঘটে।
এক সময় ধারা মিয়ার ছেলে মোগাল্যা রাজা হিসেবে সিংহাসন আরোহণ করেন। জুবান খাঁ ও ফতেহ খাঁ নামে তার দুই ছেলে ছিল। মগ জলদস্যুদের সঙ্গে জুবান খাঁর অনেক যুদ্ধ হয়। তার সেনাপতি কালু খাঁ সর্দারের সঙ্গে মুসলমান নবাবদের বড় বড় যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে দুটি বড় কামান দখল করে তারা। সেনাপতি ও রাজার ভাইয়ের নামানুসারে কামান দুটির নাম রাখা হয় কালু খাঁ ও ফতেহ খাঁ। বর্তমানে কামান দুটি ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে চাকমা রাজবাড়ীর কাচারীর সামনে রাখা হয়েছে।
ফতেহ খাঁর তিন ছেলে ছিল। তার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ ছেলে শেরমুস্ত খাঁ ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা হন। এরপর শেরমুস্ত খাঁর ভাইয়ের ছেলে শের দৌলত খাঁ ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা হন। এভাবে শের দৌলত খাঁর মৃত্যুর পর তার ছেলে জান বক্স খাঁ ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে, তার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ ছেলে জব্বার খাঁ ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে, তার মৃত্যুর পর ধরম বক্স খাঁ ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে, ধরম বক্স খাঁর মৃত্যুর পর রাণী কালিন্দী জমিদারি সংক্রান্ত বিষয়ে ভার গ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রামের মহামুণি মন্দির নির্মাণ ও মহামুণি দীঘি খনন করে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে অমর হয়ে আছেন।
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে হরিশচন্দ্র কার্ব্বারী কালিন্দী রাণীর মৃত্যুর পর রাজা হন। ব্রিটিশ সরকার তাকে চট্টগ্রামের রাজানগর ছেড়ে রাঙামাটিতে বাসস্থান পরিবর্তনের অনুরোধ করে। সেই থেকে চট্টগ্রামের রাজানগর থেকে চাকমা রাজবাড়ী স্থানান্তর হয় রাঙামাটিতে। রাজা হরিশ চন্দ্রের দুই রাণীর দুই ছেলে ছিল। ভুবন মোহন রায় ও রাণী মোহন রায়। ভুবন মোহন রায় নাবালক থাকাকালীন রাজা হরিশ চন্দ্র মৃত্যুবরণ করলে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জমিদারি ও চাকমা রাজার শাসনভার নেয় ব্রিটিশ সরকার। এরপর ১৯০৭ সালে কুমার ভুবন মোহন সাবালক হয়ে সিংহাসন আরোহণ করেন। রাজা ভুবন মোহন রায়ের মৃত্যুর পর যুবরাজ নলিনাক্ষ রায় ১৯৩৫ ইংরেজীর ৭ই মার্চ, বিভাগীয় কমিশনার মিঃ টুইনাম আই, সি, এস মহোদয় কর্তৃক রাজা গদীতে
অভিষিক্ত হন। রাজা নলিনাক্ষ রায় বি, এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া ইংরেজী সাহিত্য এম এ পর্যন্ত অধ্যায়ন করেন। রাজ কুমার বিরূপাক্ষ রায় ডিস্ট্রিক্ট কন্ট্রোলার হিসাবে চাকুরী করিয়া অবসর গ্রহন করেন। তিনি গভর্ণমেন্ট প্রদত্ত রায় বাহাদুর উপাধী প্রাপ্ত হন। রাজা নলিনাক্ষ রায় মাত্র ১৬ বৎসর রাজত্ব করেন। ১৯৩৯ ইং ৮জুন সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের জন্ম দিবস উপলক্ষে সম্রাট জয়ন্তীতে তাঁহাকে ‘রাজা’ উপাধী প্রদান করা হয়। রাণী বিনীতা দেবী একজন সাহিত্য সেবী ও সশিক্ষিতা মহিলা। তাঁহারাই আগ্রহে ও সাহায্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র পত্রিকা । "গৈরিকা” একসময় পরিচালিত হইয়াছিল। রাজা নলিনাক্ষ রায়ের সময়ে ১৯৪৭ ইং ১৪ আগষ্ট পাকিষ্ঠান স্বাধীনতা লাভ করে। বিগত ১৯৫১ইং ৭ অক্টোবর তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
তিনি সফলভাবে রাজ্য পরিচালনার করেন।১৯৫৩ সালে ত্রিদিব রায় রাজ্যভার গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজা ত্রিদিব রায় বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করার অভিযোগে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে তিনি পাকিস্তানে চলে যান। সে কারণে তার ছেলে বর্তমান চাকমা সার্কেল চিফ রাজা দেবাশীষ রায় ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর ৫১তম রাজা হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের জন্ম ১৯৫৯ সালের ৯ এপ্রিল।
চাকমা রাজার শাসন ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা
জানা যায়, বিশাল পার্বত্য রাজ্য গঠনের পর পরই পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা রাজার শাসন ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৫২০ সালে চাকমা রাজা জনুর সময় রাজ্যসীমা ছিল পূর্বে নাম্রে (বর্তমান নাফ নদী), পশ্চিমে সীতাকুন্ড পাহাড়, দক্ষিণে সমুদ্র ও চাঁইচল পর্বতশ্রেণি।
১৫৫০ সালে জো দি বরোস নামে জনৈক পর্তুগিজের আঁকা মানচিত্রে কর্ণফুলী নদীর পূর্বতীরে দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে ‘চাকোমাস’ নামে একটি রাজ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এর অবস্থান শ্রীহট্ট ও ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্বে এবং আরাকানের উত্তরে অর্থাৎ বর্তমান বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পর্যন্ত।
১৭১৪ সালের দিকে মুসলিম নবাবদের সঙ্গে চাকমা রাজা জল্লাল খাঁর যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘটে। পরে ১৭১৫ সালে চাকমা রাজকুমার ফতে খাঁর সঙ্গে মুসলিম নবাবদের শান্তি স্থাপন হয়। ১৭৬০ সালের ১৫ অক্টোবর নবাব মীর কাশিম চট্টগ্রামের শাসনভার ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামেও ইংরেজদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়। ১৭৭৭ ও ১৭৮১ সালে চাকমা রাজা শের দৌলত খাঁর সঙ্গে ইংরেজদের দুইবার যুদ্ধ এবং চাকমা রাজার জয়লাভ হয়। এরপর চাকমা রাজা জান বক্স খাঁর সঙ্গে পর পর তিন বছর (১৭৮৩, ১৭৮৪ ও ১৭৮৫ সাল) যুদ্ধ চলে। পরে ১৭৮৭ সালে চাকমা রাজা জান বক্স খাঁ কোলকাতায় গিয়ে বড়লাটের কাছে ক্ষমা চান এবং বছরে পাঁচশ’ মণ তুলা দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি করেন। ১৮৪৪ সালে চাকমা রাণী কালিন্দির সঙ্গে ক্যাপ্টেন লুইনের তীব্র দ্বন্দ্ব হয়। ১৮৬০ সালের ১ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে একটি স্বতন্ত্র জেলা গঠন করা হয়। ১৮৮১ সালের ১ সেপ্টেম্বর ‘চাকোমাস’ রাজ্যকে (বর্তমান বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম) তিনটি সার্কেলে বিভক্তিকরণ করা হয়। তার আগে ১৮৭০ সালে ঘোষিত সার্কেল বিভক্তিকরণের বিরুদ্ধে চাকমা রাণী কালিন্দির আপিল অগ্রাহ্য করা হয়। ১৯০০ সালের ১ মে ‘সিএইচটি রেগুলেশন’ বা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০’ আইন জারি করে ব্রিটিশরা। ১৯৪৭ সালের ২০ আগস্ট পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তানের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে রাঙামাটির চাকমা রাজবাড়িসহ ৫৪ হাজার একর আবাদি জমি প্লাবিত হয়। উদ্বাস্তু হয় প্রায় এক লাখ মানুষ। ১৯৬৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ‘উপজাতীয় এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করে পাকিস্তান সরকার। ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে স্বতন্ত্র সদস্য নির্বাচিত হন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়। ১৯৮৯ সালে তিন পার্বত্য জেলায় স্থানীয় সরকার পরিষদ (পরে জেলা পরিষদ) প্রবর্তিত আইনে এবং ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথাগত নেতৃত্ব ও ১৯০০ সালের শাসনবিধি বহাল রাখা হয়।
চাকমা রাজার পুরাতন রাজপ্রাসাদ 
চাকমা রাজপ্রথা
রাজা-প্রজার সেই প্রাচীন সম্পর্ক এখন আর খুব একটা দেখা যায় না। বাংলাদেশে জমিদারি অধিগ্রহণ আইনের আওতায় (পাকিস্তান আমলেই) সব রাজ-রাজাদের রাজত্ব বিলুপ্ত হয়েছে। কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামেই আজও চালু রয়েছে রাজপ্রথা। পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং এর অধিবাসীদের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় এ অঞ্চলের তিনটি প্রধান জনগোষ্ঠী চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরাদের নিয়ন্ত্রিত তিনটি প্রশাসনিক এলাকা বা রাজস্ব সার্কেল সৃষ্টি ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু বৃটিশ শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তা হতে পারেনি। ১৮৬০ সালের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ছিল দুই দলপতির হাতে। মোগল শাসনের সময়ও দুই জমিদার বা সার্কেল চিফ যথাক্রমে চাকমা রাজা ও পোয়াং (বোমাং) রাজা হিসেবে রাজস্ব আদায়ের স্বীকৃতি ছিল। ১৭৬১ সালে চট্টগ্রাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারভুক্ত হলে কোংলাপ্রু মগ বা মারমা আদিবাসীদের দলপতি হিসেবে বান্দরবান এলাকার রাজস্ব আদায়কারী নিযুক্ত হন। এরপর ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সার্কেল তিনটি গঠিত হলে কোংলাপ্রু পরিবারের বোমাং খেতাবের স্মারকরূপে বোমাং সার্কেলের নামকরণ এবং তাকে ওই সার্কেলে চিফ নিযুক্ত করা হয়। প্রচলিত আইন ও রাজ প্রথার সঙ্গে কোনো তফাৎ আছে কিনা জানতে চাইলে রাজা দেবাশীষ বলেন, আলাদা করে দেখলে আলাদা। কিন্তু যুগ অনুসারে আমরা যদি চলতে না পারি তাহলে ব্যর্থ। তবে জনগণ যদি কিছু গ্রহণ করতে না চায় এর বিকল্প তারাই ব্যবস্থা নেবে। পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর বসবাস। তাদের সংস্কৃতি লালন পালন, সংস্কার, সংযোজনে আমাদের কিছু ভূমিকা থাকে।
তিনি আরো বলেন, প্রচলিত আইন ও রাজ প্রথার সঙ্গে তেমন কোনো সাংঘর্ষিক বিষয়বস্তু নেই। বিচারের ক্ষেত্রে ১৯০০ সালের হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়েল সংস্কার করে ২০০৩ সালে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত চালু করা হয়। ফলে সিভিল প্রশাসন বা কমিশনার আদালতে যেতে হয় না। পর্যায়ক্রমে আইন কানুন সংস্কার হচ্ছে। এর ফলে রাজা বা হেডম্যান প্রথার সঙ্গে দেওয়ানি ও ফৌজদারি পদ্ধতির একটি সহাবস্থানের সুযোগ হয়েছে। 
 খাজনা আদায়
তিন পার্বত্য জেলায় রাজপ্রথা চালু থাকায় প্রতি বছর আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে রাজপূণ্যাহ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে খাজনা আদায় করেন তিন সার্কেল প্রধান। তিন পার্বত্য জেলার ভূমি রাজস্ব ঐতিহ্যগত রাজপ্রথার মাধ্যমে হেডম্যানরা আদায় করেন। তারা আদায় করা খাজনার অর্থ জমা করেন পৃথকভাবে সরকার, রাজা এবং হেডম্যানের অংশে। রাঙমাটির রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত রাজপূণ্যাহ অনুষ্ঠানে চিরাচরিত নিয়মে চাকমা সার্কেলের মৌজা হেডম্যানদের কাছ থেকে খাজনা আদায় এবং ঐতিহ্যবাহী নিয়মে তরবারি সমর্পণের মাধ্যমে হেডম্যানরা রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ২০০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজ্যাভিষেকের রজতজয়ন্তী ও রাজা দেবাশীষের ছেলে রাজপুত্র ত্রিভূবন আর্য্যদেব রায়কে যুবরাজ হিসেবে অভিষিক্ত করতে এক আড়ম্বরপূর্ণ রাজপূণ্যাহ আয়োজন করে চাকমা রাজপরিবার। ওই অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন। খাজনা প্রসঙ্গে রাজা দেবাশীষ বলেন, আমরা মূলত তিন ধরনের খাজনা আদায় করে থাকি। এগুলো হচ্ছে, জুম খাজনা পরিবার পিছু বাৎসরিক ৬ টাকা। এর মধ্যে রাজার অংশ আড়াই টাকা। বাকি অংশ পায় সরকার। জমির খাজনা করা হয় গ্রোভল্যান্ড (উঁচুভূমি) এবং ফ্রিঞ্জল্যান্ড (নিচুভূমি) থেকে। এ খাজনার মধ্যে রাজার অংশ ৪২, হেডম্যান ২৭ এবং বাকি অংশ সরকারের। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিমালার ৪৩(১) মতে, সব শ্রেণির প্রজার নিকট থেকে হেডম্যান খাজনা আদায় করবেন। গ্রোভল্যান্ড ব্যতীত অন্যান্য ভূমি থেকে আদায়কৃত খাজনার জন্য কি পরিমাণ কমিশন প্রদান করা হবে তা সব সময় সরকার নির্ধারণ করবে। হেডম্যান আদায়কৃত খাজনা জেলা প্রশাসকের নিকট জমা দেবেন। জেলা প্রশাসক কারণ উল্লেখপূর্বক সংশ্লিষ্ট সার্কেল চিফ ও মৌজা হেডম্যানের সুপারিশক্রমে জুম খাজনা হ্রাস বা মওকুফ করতে পারেন। মৌজা হেডম্যানরা নিজ নিজ এলাকার প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে থাকেন। আদায় করা খাজনা প্রতি বছর রাজপূণ্যাহ অনুষ্ঠানে রাজার কাছে জমা দেন তারা। নিয়মতি রাজপূণ্যাহ আয়োজন করা না হলে হেডম্যানরা আদায় করা খাজনা সুবিধা মতো সময়ে পরিশোধ করতে পারেন।
রাঙ্গামাটি চাকমা সার্কেল
রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার ৫টি ও রাজস্থলী উপজেলার ৯টি মৌজা বাদে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার ২১টি, খাগড়াছড়ি সদরের ১২টি এবং রাঙামাটি জেলার ১৪৪টি মৌজাসহ মোট ১৭৭টি মৌজা নিয়ে চাকমা সার্কেল গঠিত। মৌজাগুলোর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন হেডম্যান বা মৌজা প্রধানরা। তারা প্রথাগত নিয়মে সামজিক বিচার-আচারসহ স্থানীয়ভাবে সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪৭ ধারার আইন অনুযায়ী, বিভাগীয় কমিশনারের মঞ্জুরি সাপেক্ষে সার্কেল প্রধান যে মৌজার অধিবাসী সে মৌজাকে খাস মৌজা হিসেবে অধিকারে রাখতে পারেন। সেক্ষেত্রে মৌজা প্রধান হিসেবে তিনিও নিজে হেডম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। হেডম্যানের জন্য নির্ধারিত সম্মানী ভাতা ও পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন তিনি।
বর্তমানে চাকমা সার্কেল চিফ চারটি মৌজা নিজের দায়িত্বে পরিচালনা করেন। সার্কেল চিফগণ জেলা প্রশাসকের উপদেষ্টা কাউন্সিলর হিসেবে পরিগণিত হন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট সার্কেল সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য ও উপদেশ দিয়ে জেলা প্রশাসককে সহায়তা করেন। সার্কেল চিফগণ তাদের কর্তৃত্বের প্রভাব বলয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সার্কেলের আওতাধীন মৌজাগুলোতে জেলা প্রশাসকের আদেশ কার্যকরীকরণ নিশ্চিত করে থাকেন। তারা ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে রাজস্ব আদায়, গণশান্তি, কল্যাণমুখী প্রশাসন ইত্যাদি বিষয়ে মৌজা হেডম্যানদের দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। আইনের ৪০ ধারা মতে, প্রচলিত রীতি অনুসারে উপজাতীয় বিরোধগুলো বা হেডম্যানদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেরিত বা হেডম্যানগণ নিজেরাই দাখিল করেছেন এমন বিরোধগুলোর বিচার সার্কেল চিফরা নিষ্পত্তি করেন। এছাড়াও সার্কেল চিফদের আরও অনেক দায়িত্ব ও ক্ষমতা রয়েছে প্রথাগত আইনে। সার্কেল চিফ বা রাজা বর্তমানে সরকার থেকে মাসিক ১০ হাজার সম্মানী ভাতা পেয়ে থাকেন। এছাড়া আদায়কৃত জমির খাজনার ৪২ ভাগ পেয়ে থাকেন। 
চাকমা সার্কেলের ৫১তম রাজা দেবাশীষ রায় 
পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০ সালের আইনের ৪৮ ধারা মতে, সার্কেল প্রধান বা রাজার পদে অভিষিক্তকরণ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তান চলে যাওয়ায় শূন্য হয় রাজ সিংহাসনটি। স্বাধীনতা পরবর্তী তৎকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মালেক উকিল ১৯৭৩ সালের ৩০ এপ্রিল রাঙামাটি সফরে আসলে চাকমা রাজার বাড়িতে বেড়াতে যান। ওই সময় তিনি রাজা ত্রিদিব রায়ের ছেলে দেবাশীষ রায়ের ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হলে তাকে সিংহাসনে বসানোর সম্মতি দেন। পরে রাজপদে অভিষিক্তকরণের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৫/৫/৭৪ খ্রিস্টাব্দ তারিখের ৪১৫ শাখা (১) প্রজ্ঞাপন মূলে নিয়োগ আদেশ জারি করা হয়েছিল। তারই আলোকে ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর ১৮ বছর পূর্ণ হলে দেবাশীষ রায় আনুষ্ঠানিকভাবে রাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি রাঙামাটি চাকমা সার্কেলের ৫১তম রাজা।
চাকমা রাজ পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৪ সালে রাজা নলীনাক্ষ রায়ের মৃত্যুর পর তার ছেলে ত্রিদিব রায় রাজার সিংহাসনে বসেন। রাজা ত্রিদিব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পাকিস্তান চলে যান। সে সময় তার ছেলে দেবাশীষ রায় নাবালক ছিলেন। সেজন্য রাজা ত্রিদিব রায়ের ছোট ভাই কুমার সুমিত রায় রাজ প্রতিনিধির দায়িত্বে কাজ করেন। পরে আঠারো বছর পূর্ণ হলে দেবাশীষ রায় রাজসিংহাসন আরোহণ করেন। রাজা দেবাশীষ রায় যুক্তরাজ্য হতে বার-অ্যাট-ল ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় জনগণের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। প্রবাদ আছে ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার।’ কালের বিবর্তনে প্রবাদটির বাস্তব রূপ এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী তিন রাজার বেলায়। বাংলাদেশে সম্ভবত শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজপ্রথা চালু রয়েছে। তবে রাজপ্রথা থাকলেও ঐতিহাসিক শাসনক্ষমতা রাজাদের আর নেই। খর্ব করা হয়েছে রাজাদের প্রথাগত শাসন ক্ষমতা। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান তিন রাজার মধ্যে রাঙামাটির চাকমা সার্কেল চিফ হলেন রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়। বান্দরবানের বোমাং সার্কেল চিফ কেএসপ্রু ২০১৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন। জানা যায়, প্রয়াত রাজা কেএসপ্রু ২০১২ সালের ২০ নভেম্বর ১৬তম রাজা হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন। খাগড়াছড়ির মং সার্কেল চিফ হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন রাজা সাচিংপ্রু চৌধুরী।তথ্যসূত্র মতে, এক কালে পার্বত্য অঞ্চলের ওই তিন রাজার ছিল দুর্দান্ত প্রতাপ আর অসীম রাজকীয় প্রভাব। বিশেষ করে চাকমা সার্কেলের রাজা ছিলেন সবচেয়ে বেশি প্রতাপশালী ও ক্ষমতাধর। কালের বিবর্তনে সেই ঐতিহ্য আর ক্ষমতা খর্ব হওয়ায় রাজাদের অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্য। এখন আর ঐতিহাসিক সেই শাসনক্ষমতা নেই পার্বত্য তিন রাজার। তবে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের নিদর্শন নিয়ে চালু রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজপ্রথা। পাশাপাশি বজায় রয়েছে প্রথাগত সামাজিক বিচার-আচার, খাজনা আদায়, ঐতিহ্যগত সংস্কৃতিসহ বিশেষ কার্যাদি। পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজপ্রথা আইনের পাশাপাশি প্রথাগত আইন প্রচলিত ও বিচারর্য্য। কিন্তু ঐতিহাসিক শাসনক্ষমতা খর্ব হওয়ায় রাজারা এখন অনেকটা নামেই। বলা চলে কাগুজে রাজা। তারপরও এমন তিন রাজার তিন রাজ্য টিকে আছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে।
জানা যায়, তিন রাজার মধ্যে চাকমা রাজার আধিপত্যের গোড়াপত্তন হাজার বছরের আগে। ঐতিহাসিক বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৫০০ সালের দিকে এখানে রাজ্য দখল ও রাজত্ব শুরু করেন চাকমা রাজবংশীয়রা। সেই থেকে রাজপ্রথার সূচনা। বৃটিশরা এ প্রথাকে স্বীকৃতি দেয়। পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন রাজার ক্ষমতা, দায়িত্ব এবং অস্তিত্বের স্বীকৃতি দেন। প্রচলিত রয়েছে ১৯০০ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি চলে আসছে। চাকমা সার্কেলের বর্তমান রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বিগত তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রধান উপদেষ্টার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারীর (প্রতিমন্ত্রীর পদ মর্যাদায়) দায়িত্ব পালন করেন।
এ ব্যাপারে চাকমা সার্কেল চিফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় জাগো নিউজকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুগ যুগ ধরে বিশেষ শাসন ব্যবস্থায় শাসিত। এখানে প্রথাগত শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি অনুযায়ী সামাজিক বিচারকার্য পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে বর্তমানে বিভিন্নভাবে প্রথাগত আইন ও ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে। ফলে এখানকার রাজ প্রথার অনেক ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতির অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। এছাড়া প্রথাগত নেতৃত্ব, সার্কেল চিফ, হেডম্যান, কারবারিদের অফিস-কাচারিসহ নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান। শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তাদের যে ভূমিকা সেই তুলনায় সম্মানী ব্যবস্থা একদম নগণ্য। এসব সমস্যার উত্তরণে প্রয়োজন সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চাকমাদের খাঁ, রায়, খীসা, দেওয়ান ও তালুকদার উপাধি

নিঝুম তালুকদার আমি পুর্বের আলোচনাতে চাকমা রাজ বংশের বংশানুক্রমিক ও পিরি নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আর নতুন করে সে বিষয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন নেই। তাই সংক্ষেপে আলোচনা শুরু করছি। সবাই সাথে থাকুন। পড়তে থাকুন। জনু রাজার পুত্র ছিল না―শুধু দুই কন্যা। জনু রাজা ১২০ বৎসর পৰ্যন্ত জীবিত ছিলেন। বড় কন্যা সাজোম্বীকে মগ রাজা বিবাহ করে। দ্বিতীয় কন্যা রাজেস্বীকে বুড়া বড়ুয়া বিবাহ করেন। বুড়া বড়ুয়ার পুত্র সাত্তুয়া রাজা হন। তিনি পরে পাগলা রাজা বলে প্ৰসিদ্ধ হন। পাগলা রাজা অতিশয় জ্ঞানী ছিলেন। কথিত আছে মন্ত্র বলে তিনি চিৎকলিজা বের করে ধৌত করে আবার ঢুকিয়ে রাখতেন। এই কার্য করতে তাঁর রাণী উকি দিয়ে দেখলে, তিনি আর ঢুকাতে পারলেন না। তাঁতে প্রকৃত পাগল হন। যাকে তাকে কাটতে লাগলেন। সেজন্য তার রাণীর সম্মতিতে তাকে হত্যা করা হয়।  প্ৰবাদ আছে- "তিনি একদিন টংগীতে বসেছিলেন এবং জংগলী হাতী এসেছে বলে পূর্ব প্ৰস্তাব মতে মিথ্যা রটনা করাতে বন্য হাতী দেখবার জন্য মাথা বের করলেন। তখন পেছনদিক হতে তার শিরচ্ছেদ করা হয়।" পাগলা রাজার মৃত্যুর পর রাণী রাজকাৰ্য চালান। “কাটুয়া কন্যার” আমল বলে তার দুর্না...

কাপ্তাই বাঁধ ও রড়পোরং

নিঝুম তালুকদার কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ পার্বত্যঞ্চলের এক বেদনাদায়ক যুগান্তকারী ঘটনা। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে এই বাঁধ নির্মাণ এই অঞ্চলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়। বিষয়টি এখনও বির্তকিত রয়েছে। পৃথিবীর অনেক আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে উন্নয়নের নামে যে সব প্রকল্প ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বির্পযয় ও বিলুপ্তির জন্য দায়ী কাপ্তাই বাঁধ তন্মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এই বাঁধ অত্রাঞ্চলে পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক বিপর্যয়।  পার্বত্য অঞ্চলের জৈব্য বৈচিত্র্য, পরিবেশ ধ্বংস ছাড়াও চাকমা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকজনকে বিলুপ্তির কাছাকাছি এনেছে কাপ্তাই বাঁধ। কাপ্তাই বাঁধ পার্বত্যঞ্চলের জনগণের তথা চাকমা জনগোষ্ঠীর দূর্গতির মূল কারণ। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নের নামে নির্মিত এই বাঁধ পার্বত্য অঞ্চলের অন্যতম আদিবাসী জনগোষ্ঠী চাকমা সম্প্রদায়কে বিলুপ্তি ও ধ্বংসের প্রান্তে এনেছে। আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে এই বাঁধ নির্মিত হলেও এর বিরুপ প্রভাব এখনও বিদ্যমান। ভৌগলিক, পরিবেশগত ও জৈব্য বৈচিত্র্যের উপর এর অবর্ণনীয় ক্ষতিকর প্রভাব হাজার বছরব্যাপী অত্রাঞ্চলে বিরাজ করবে। বাঁধ নির্মাণ কার্য যারা প্রত্য...

চাকমা জাতির এক মহীয়সী নারী চাকমা রাণী কালিন্দী

 ইলিরা দেওয়ান চাকমা রানী কালিন্দী কে নিয়ে সকলের মুখে প্রায়ই শোনা যায় যে চাকমা রাণী কালিন্দীর কারনে চাকমা জাতি রাজ্যহারা। তারই ভুলের জলন্ত আগুনের মশালে দহনীয় সমগ্র চাকমা জাতি। রাণী কালিন্দীর বিরদ্ধে সবার মাঝে যে ধারনা সেই বিষয় নিয়ে আজকের সংক্ষিপ্ত আলোচনা । সবাই সাথে থাকুন। পড়তে থাকুন।  বৃটিশ আমলে উপমহাদেশের মহীয়সী নারীদের বীরত্ব গাঁথা কিংবা সমাজে তাঁদের অবদানের কথা বললে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে নবাব ফয়জুন্নেসা, বেগম রোকেয়াদের কথা। কিন্তু তাঁদের জন্মেরও পূর্বে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আরেক মহীয়সী নারীর কথা ক’জনইবা জানেন! উনিশ শতকের প্রথমদিকে রাস্তাঘাটহীন দূর্গম পার্বত্য এলাকার কুদুকছড়ির সাধারণ এক চাকমা জুমিয়া পরিবারে জন্মেছিলেন কালাবি চাকমা। পরবর্তীতে চাকমা রাজা ধরম বক্স খাঁ এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তিনি ‘কালিন্দী রাণী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠলেও তিনি স্বশিতি ছিলেন এবং তাঁর প্রাজ্ঞ দিয়ে রাজপরিবারের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে সম হয়েছিলেন। কালিন্দী রাণী শুধু বৈষয়িক বুদ্ধিতে কিংবা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দূরদর্শিতায় প্রাজ্ঞ ছিলেন ...

চাকমা রাজবংশের ইতিহাস

নিঝুম তালুকদার আমরা তখন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরনার্থী অবস্থায় ছিলাম। সেখানে অনেক ছেলে- মেয়েকে আমার আজু প্রায়ই গল্প শুনাতেন। একদিন আজু আজকের আলোচনা বিষয়টি সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক সত্য ঘটনার গল্প বলেছিলেন। আজু যে ভাবে বলেছিলেন ঠিক সেইভাবে ঐ ঘটনার কথা নিয়ে আজকে আলোচনা করতে যাচ্ছি। সবাই সাথে থাকুন। চাকমা রাজপরিবার ইতিহাস অনুসারে সময়টা আনুমানিক ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগ। চম্পক নগরের রাজা সাংবুদ্ধ। সাংবুদ্ধর দুই ছেলে- বড় ছেলের নাম বিজয়গিরি এবং ছোট ছেলের নাম সমরগিরি। যুবরাজ বিজয়গিরি যুদ্ধবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। ছেলেবেলা হতেই তিনি রাজ্য জয় ও রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখতেন। চম্পক নগরের ভাবি রাজা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন।  ত্রিপুরার দক্ষিনে অবস্থিত মগ রাজ্য। মগরা ছিল দুস্য প্রকৃতির। তারা শহর ও গ্রামে লুন্ঠণ এবং মানুষের ওপর অত্যাচার করে বেড়াত । ত্রিপুরা রাজের অধিভূক্ত দক্ষিনাঞ্চলেও তাদের দৌরাত্ম্য থেকে মুক্ত ছিল না । এসময় ত্রিপুরা রাজ্যে অন্তঃবিপ্লবের সম্ভাবনা থাকায় রাজা মগদের দমনে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেনি। যুবরাজ বিজয়গিরি তার সামরিক অভিয...

চাকমা রাজবংশের বিজক ও পিরি

নিঝুম তালুকদার ৫১তম চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের রাজপিরি ও বিজোগ বিগত কয়েক দিন আগে আমার আলোচনা পোষ্টে "চাকমা রাজবংশের ইতিহাস"টি নিয়ে বিভিন্ন মহলের আরো চাকমা রাজবংশের ইতিহাস সর্ম্পকে জানার আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। তাতে আমারও উৎসাহ অগ্রসর হয়। আমিও উৎসাহ নিয়ে বিজোক ইতিহাস ঘাটাঘাটি করি। ইতিহাস সুত্রমতে বর্তমান চাকমা সার্কেলের রাজা দেবাশীষ রায়ের আমলে তিনি ৫১তম চাকমা রাজা যেভাবে হলেন তা নিয়ে আলোচনা শুরু করি। ০১. অতি পুর্বকালে হিমালয়ের পাদদেশে শাক্য নামে এক রাজা ছিলেন। কলাপ্যা নগর তার রাজ্যের রাজধানী ছিল। তিনি ঐ নগরে ঈশ্বরের এক মূর্তি প্ৰস্তুত করিয়ে পূজা করতেন। ঐ রাজার বংশজ মন্ত্রীর নাম সাংকুস্য। মন্ত্রীরাজ রাজধানী শাসনের ভার নিয়ে দুষ্ট দমন করে সাবধানে প্রজা পালন করতেন। ০২. শাক্যরাজার পুত্ৰ সুধন্য মহা তেজস্বী হয়ে সর্বদা ক্ষত্ৰিয়ভাবে রিপু দমন করে বীর ভাব প্রকাশ করে থাকতেন। সাংকুস্য মন্ত্রীর পুত্ৰ জয়ধন সেনাপতির সংগে মহারাজ সুধন্য যুদ্ধসজ্জায় সর্বদা সজ্জিত থাকতেন এবং শত্রু দমনে সাবধান থাকতেন। সুধন্য মহারাজের দুই রাণী, তিন পুত্র ছিল। বড়রাণীর গর্ভজাত গুণধন রাজভো...

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও ইতিহাস

নিঝুম তালুকদার আদিবাসী প্রসঙ্গ বস্তুতঃ বাংলাদেশে ‘ইন্ডিজেনাস’ বা ‘আদিবাসী’ কারা তা একটি মীমাংসিত বিষয়। কিন্তু তারপরও সরকার ও বাঙালী জাত্যাভিমানী-সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন একটি গোষ্ঠী জেনেও না জানার ভান করে আদিবাসী নিয়ে বিতর্কের অবতাড়না করছে। বিষয়টিকে জটিল রূপ দিয়েছে। ‘আদিবাসী’ বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল বা বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে সরকার আদিবাসীদের ন্যায্য অধিকারকে অস্বীকার করতে চাইছে অথবা তার দায়দায়িত্ব থেকে সরে যেতে চাইছে। অন্য কোন দেশে এমন হয়নি। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ এবং গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তি বলে দাবীদার আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছে। আবার বলা যেতে পারে, সরকার বর্তমানে আদিবাসী বিষয়ে ও আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে বা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। অথবা আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে সরকার যে চরম রক্ষণশীল, এমনকী প্রতিক্রিয়াশীল- তার মুখোশই উন্মোচিত হয়েছে। এ জন্য এই সরকারকে একদিন মাশুল দিতে হবে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের আদিবাসীরা হুট করে নিজেরাই নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ বলে দাবী করে বসেনি। জাতিসংঘ...

জুম্মবির অতীত কথা ও স্মৃতি

তারাচরন চাকমা জুম্মবিতে লেখার, বলার ও প্রকাশ করতে সাহজ ও উৎসাহ দিয়ে সবসময়  সাথে থাকবেন। জুম্ম ঘরে জন্ম হওয়াতে তার নাম জুম্মবি। জুম্মবির তেরোটি জাতি সত্বার দশ ভাষার ছোট একটি দেশ জুম্ম দেশ। দশ ভাষায় কথা বলাতে তাকে ভাষাবিও ডাকা হয়। চার দিকে সবুজ সবুজ মুড়ো ও পাহাড় নিয়ে জুম্মবির জুম্মদেশে প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সাইনো তিব্বতী মঙ্গোলয়ড ১৩ টি জাতিগোষ্ঠী এখানে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেছে। প্রায় ৫,০০,০০ (পাঁচ লক্ষ)জনসংখ্যার অভিবাসী জুম্মজাতি প্রধান দু'টি হলো চাকমা এবং মারমা। এরা ছাড়াও আছে ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, পাংখো, ম্রো, খিয়াং, বম,খুমি, চাক,গুর্খা, আসাম। খুব সুখে ছিল সেখাানে তারা। জুম্মবির জুম্মদেশে দশ ভাষা ভাষি তেরোটি জাতি ছাড়া অন্য কোন জাতি ছিল না। ১৫৫০ সালের দিকে প্রণীত বাংলার প্রথম মানচিত্রে বিদ্যমান ছিল। তবে এর প্রায় ৬০০ বছর আগে ৯৫৩ সালে মগধের চম্পক নগরের রাজা উদয় গিরি এই অঞ্চল অধিকার করেন। ১২৪০ সালের দিকে ত্রিপুরার রাজা এই এলাকা দখল করেন। ১৫৭৫ সালে আরাকানের রাজা এই এলাকা পুনর্দখল করেন, এবং ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত অধিকারে রাখেন। মুঘ...

বৃটিশ শাসনে চাকমা জনগোষ্ঠীর সম্পাদনা

নিঝুম তালুকদার পলাশীর যুদ্ধের তিন বছর পরে, মুর্শিদাবাদের নতুন নবাব মীর কাশিম বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে চট্টগ্রাম বর্ধমান এবং মেদিনীপুর উপহার হিসেবে দিয়ে দেন। যেটি গতকাল আলোচনায় বলা হয়েছে। দিনটি ছিল ৫ জানুয়ারী ১৭৬১ সালে, কোম্পানীর প্রতিনিধি হ্যারি ভেরেলস্ট চট্টগ্রামের শাসনভার সুবেদার মোহাম্মদ রেজা খানের কাছ থেকে গ্রহন করেন। তবে তখনো চাকমা রাজা শের দৌলত খান স্বাধীনভাবে তার রাজ্য পরিচালনা এবং মুঘলদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। এবং কোম্পানীর শাসন মেনে না নিয়ে কোম্পানী কর্তৃক ধার্য নির্ধারিত খাজনা প্রদানে বিরত ছিলেন। ফলে কোম্পানির সাথে একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের সূত্রপাত হয়, যা ১৭৮৭ সালপর্যন্ত চলেছিল। কোম্পানী চাকমা রাজের বিরুদ্ধে চারটি যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। সেগুলো হল - ১৭৭০, ১৭৮০, ১৭৮২ এবং ১৭৮৫ সালের যুদ্ধ। যুদ্ধে কোম্পানী বিশেষ সুবিধে করতে না পারায় এবং চাকমা রাজ্যে বাণিজ্য অবরোধের ফলে সৃষ্ট সমস্যায় - দুই পক্ষই ১৭৮৫ সালে একটি শান্তি আলোচনা চালায়। চাকমা রাজের পক্ষে রাজা জানবক্স খান, শের দৌলত খানের পুত্র অংশ নেন। পরবর্তীতে ১৭৮৭ সালে কলকাতায় চাকমা রাজের সাথে কোম্প...